১৪ ফেব, ২০০৮

রক্তাক্ত মধ্য ফেব্রুয়ারির স্মৃতি

আজ মধ্য ফেব্রুয়ারি।
১৯৮৩-র এই দিনে শিক্ষাভবন অভিমুখে আয়োজিত মিছিলের উপর পুলিশের ট্রাক চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় জাফর, জয়নাল, আইয়ূব, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ নাম না জানা আরও বেশ কিছু ছাত্রকে। বছর দুয়েক পর এই মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যা করা হয় রাউফুন বসুনিয়াকে।

নব্বুই-এর দশকে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে বেড়ে উঠার সময় পত্রিকার পাতায় স্মৃতিচারণ থেকেই জেনে ছিলাম স্বৈরশাসনের সূচনালগ্নের সেই প্রতিবাদ মুখর উত্তাল দিনগুলোর কথা। ভালোবাসা দিবসের উন্মাদনায় আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে সেই প্রতিবাদী সময়ের স্মৃতি, হারিয়ে গেছে সেই “রক্তাক্ত মধ্য ফেব্রুয়ারি” শব্দ-গুচ্ছটি।

সেই সময়ে স্মৃতি ছোঁয়া একটি কবিতা।
কবিতার নাম “তোমাকে মনে পড়ে যায়”। কবি মোহন রায়হান।
শিমুল মুস্তাফার কণ্ঠে আবৃত্তিতেই ফিরে পেয়েছি এই পুরনো কবিতা।


মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট,
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দিবে তুমি

ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে
কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা
প্রতিটি পা ফেলছ কি দৃঢ় প্রত্যয়ে
কি উচ্চকিত তোমার কণ্ঠের শ্লোগান
যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে
হাত উঠছে হাত নামছে
মাথা ঝুঁকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে
ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি

মধুর ক্যান্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম, মিছিল সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দুর্জয় শপথ
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে
শিক্ষাজীবন, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে
ডাক দেই দেশবাসীকে

তোমারি মত নিরাপত্বাহীনতায়
প্রতিটি ছাত্রের দুর্বিষহ জিম্মীজীবন এখনো এ ক্যাম্পাসে
হলে গেটে গেটে পড়ে থাকে ভয়ংকর বিস্ফোরন্মোখ তাজা বোমা
প্রতিদিন চর দখলের মত হল দখলের হিংস্র মহড়া
গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ
এখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ
এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?

মধুর ক্যান্টিনে যাই
প্রতিদিন আমাদের জীবন হাতের মুঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার

শিক্ষাভবন অভিমুখে সামরিক শাসন ভাঙ্গার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারির কাফেলায় তুমি ছিলে
৪ঠা আগস্ট সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের কবল থেকে
আমাদের পবিত্র মাটি রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোন ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল আন্দোলন নেই যে তুমি ছিলে না

সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও
তুমি অস্ত্রধারীদের দুর্গের দিকে অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে
ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু তুমি পিছু হটোনি
তুমি বীর, তুমি সাহসী যোদ্ধা, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্রেরণা

মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

কাউন্টারের সামনে কতদিন
তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি
কতদিন তুমি আমাকে চায়ের পয়সা দিতে দাওনি
কতদিন চায়ের সঙ্গে একটি সিঙ্গারা বা কেকের আবদার করেছ
কতদিন তোমার সঙ্গে খোশগল্প হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছি
বসু, আজ সব কথা মনে পড়ে যায়।

রিপার বিয়েতে তুমি বলেছিলে
অ্যাকশনে আপনার আর আগে থাকার দরকার নেই,
আমরা তো আছি
বসু, তুমি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে গেলে
বসু, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি রক্তকরবী বৃক্ষ

মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।

তোমার মৃত্যুর সেই নৃশংস ঘাতক রাত্রিতে
আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে
তোমার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ আমি দেখিনি
তোমার মৃত্যুর খবর শুনে
বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিল মন
তবু সেই রাত্রেই আড়াই-শত মাইল দূর থেকে
সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিয়েছিলাম
তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে
তোমার খুনিদের রক্তে হাত রাঙ্গাতে

বসু, আমরা বহুবার তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেবার শপথ গ্রহণ করেছি
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে, শহীদ মিনারে, বটতলায়, বায়তুল মোকারমে,
সারাদেশ তোমার হত্যার বদলা চায়
কিন্তু এখনো তোমার খুনিরা প্রকাশ্যে সগর্বে ঘুরে বেড়ায়
এখনো তোমার ঘাতকেরা ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে
রাইফেল তাক করে আছে আমাদের প্রতি

বসু, আমাদের শিক্ষানীতি এখনো বদলায়নি
সামরিক খাতে ব্যয় শিক্ষাখাতের চেয়ে আরও বেড়েছে
নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা হলেও
সংস্কারের অভাবে জগন্নাথ হলের জীর্ণ ছাদ ধ্বসে
তোমার অনেক বন্ধু মারা গেছে
এখনো হলে হলে মেধা-ভিত্তিক সিট বণ্টন চালু হয়নি

বসু, তুমি এসবের পরিবর্তন চেয়ে জীবন দিয়েছ
কিন্তু আমরা এখন তোমার একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারিনি
বসু, আমরা তোমার কাঙ্ক্ষিত লড়াই চূড়ান্ত করতে পারিনি
আমরা তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি
আমরা এখনো অজস্র বসু হতে পারিনি বলেই...

মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
খুব মনে পড়ে।