২০ ডিসে, ২০১৩

খেলারাম খেলে যা

আমরা স্বাভাবিকতাকে ভয় পাই। শরীরকে ভয় পাই। ইচ্ছাকে ভয় পাই। আমরা আমাদের কামনাকে নিয়ে বিব্রত। বুকে হাত দিয়ে কটা লোক বলতে পারবে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখে তার ইচ্ছে হয়নি? যদি কেউ বলে তার হয়নি, আমি বলব, সে অসুস্থ নয়তো মিথ্যুক।
-                                                                                        ----  সৈয়দ শামসুল হক, খেলারাম খেলে যা, ১৯৭০

তেঁতুল দেখলে যেমন মুখে লালা আসে, মহিলা দেখলেও তেমনি দিলের মধ্যে লালা বের হয়, মনের মধ্যে কু-খেয়াল এসে যায়। কেউ যদি বলে মহিলা দেখলে আমার দিলের মধ্যে কু-খেয়াল আসে না, তাহলে আমি বলব, ভাই তোমার ধ্বজভঙ্গ বিমার আছে।
-                                                                                      --- আল্লামা শাহ আহমদ শফি, হেফাজতে ইসলাম, ২০১৩

আমাদের শফি হুজুর তো মনে হয় ধর্মীয় কিতাব বাদ ফেলে খেলারাম খেলে যা পড়তে গিয়েই  যতসব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন J



১৮ ডিসে, ২০১৩

কুকুর হইতে সাবধান

তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান ও কুকুরের মাঝে এই সাদৃশ্য কিছু দুষ্টু মানুষ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেও জাতি হিসাবে আমরা এই সাদৃশ্যের কথা কিন্তু জেনে গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালেই। কুকুর হইতে সাবধান।


১৭ ডিসে, ২০১৩

কী সুন্দর ফাজলামি করে !

প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে দুঃখ ছিল যে অভিনয় শিল্পী হিসাবে প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে আসার পরও লোকে তাকে একজন অভিনেতা হিসেবে না দেখে কেবল একজন কমেডিয়ান হিসেবে গণ্য করে। তার নিজের মাসিমাকেই তিনি বলতে শুনেছেন, দিদি, নাটকে ভানুকে দেখেছেন? কী সুন্দর ফাজলামি করে

পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে কাদের মোল্লার ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব পাশের কথা শুনে আমার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। ১৯৭১ এর ৩রা মার্চ পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসার কথা ছিল । কিন্তু ১লা মার্চ তারিখে সেই অধিবেশন স্থগিত করে দেয়ার পরপরই বাঙ্গালীর জীবন থেকে সেই ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির গুরুত্ব চিরতরে হারিয়ে গেছে। বাঙ্গালীর হাতে মারা-খাওয়া পাকিস্তানের সেই ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি এখন যতই পার্লামেন্ট-পার্লামেন্ট ভাব নিয়ে গুরুগম্ভীর প্রস্তাব পাশ করুন না কেন তার মূল্যায়ন আমাদের কাছে ভানুর মাসিমার মতোই...কী সুন্দর ফাজলামি করে!

১৮ নভে, ২০১৩

তাগড়ার মল্লযুদ্ধ

গতকাল ছিল ১৭ই নভেম্বর।  ১৯৭১ এর ১৭ই নভেম্বর বরিশালের কোদালধোয়া এলাকায় শহীদ হন নাম না জানা এক সাহসী যোদ্ধা। নাম না জানা আরও অনেক শহীদের মাঝে সে একটু ব্যতিক্রম। শুধু মৃত্যুতেই তার নাম হারিয়ে যায়নি, জীবিত থাকতেই সে হারিয়ে ফেলেছিল বাবা-মার দেয়া নাম। সবাই তাকে ডাকতো তাগড়া নামে। বাবা-মার দেয়া নাম জানা ছিল না। বরিশাল অঞ্চলে চর-দখলের লড়াকু লাঠিয়াল সে। তার বিশাল বুক জুড়ে ছিল তিন তিনটি বল্লমের আঘাতের দাগ। মাথায় ঘন কালো চুল আর দীর্ঘদেহের এই অমিত শক্তিমান লাঠিয়াল চর অঞ্চলে এতোই প্রতাপসম্পন্ন ছিল যে তার শরীরের সাথে মানানসই এই তাগড়া নামেই সকলে তাকে জানতো। 

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। বরিশাল অঞ্চল পাক-হানাদার বাহিনীর দখলে। বরিশালের স্বরূপকাঠিতে শর্ষিনার পীরের বাড়ি তখন পাক বাহিনীর আস্তানা ও স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। সেখানে আস্তানা গেড়ে পীর সাহেবের আতিথেয়তা ও সহযোগিতায় স্বরূপকাঠি ও ইন্দোরহাট এলাকায় পাক বাহিনী তখন নারকীয় তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। পীর সাহেবের আস্তানায় ঘাটি গেড়ে বসা থেকে এই হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দেয়ার জন্য সুন্দরবন থেকে একযোগে এগিয়ে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের  ১৫/১৬টি দল। লে: সাঈদের নেতৃত্বে ৫১ জনের  এমনই একটি দলের সদস্য তাগড়া। মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে ততদিনে লাঠিয়াল থেকে তাগড়া পরিণত হয়েছে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধায়। যুদ্ধে সাহসিকতা আর রাজাকারদের ধরে  নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলো সে। 

১৭ই নভেম্বর, বুধবার। নাজিরপুর-পিরোজপুর-পাটগাতি-কোটালিপাড়া পেরিয়ে  তাগড়াদের দল তখন এসে পৌঁছেছে কোদালধোয়া এলাকায়। ঠিক সে সময় আচমকা অপরদিক থেকে অগ্রসরমান শতাধিক পাক সৈন্যের এক দলের মুখোমুখি হয়ে গেলো লে: সাঈদের দল। মাত্র দেড়শ গজ ব্যবধানে অবস্থান নিয়ে অনেক সময় ধরে গুলি-পালটাগুলি চলল দুই পক্ষের মধ্যে। একে অন্যের শক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দুই পক্ষই সতর্ক অবস্থানে থেকে চলতে চাইছে। দিনভর চলতে থাকা লড়াইয়ের পর হঠাৎ করেই থেমে গেল সব গোলাগুলি। সুনসান নীরবতা। স্নায়ুতে প্রবল চাপ। এর মাঝেই হঠাৎ করে বিশাল-দেহী এক পাকসেনা অস্ত্র মাথার উপর ধরে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে গিয়েই  পরনের সেনা পোশাক একটানে ছিঁড়ে ফেলে দিলো।    ক্লান্তিকর এই যুদ্ধে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এই হানাদার সৈনিক। চিৎকার করে বলতে লাগলো, সতী মায়ের দুধ খেয়ে বড় হওয়া কেউ যদি থাকে তো এগিয়ে আসো খালি হাতে। বলেই হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে। পাগলাটে এই পাকসেনার কান্ড দেখে হতবাক মুক্তিযোদ্ধারা কেউ গুলি ছুঁড়ল না।

খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া তাগড়া তখন অস্ত্র হাতে তার পজিশনে শুয়ে আছে। হানাদার সৈন্যের এই দাম্ভিক চ্যালেঞ্জ শুনে সে আর শুয়ে থাকতে পারলো না।  লে: সাঈদের দিকে এক নজর তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলোহালায় মনে করছে কি? বাঙ্গালী গো মধ্যে কি কেউ নাই তার লগে লড়তে পারে? মিয়া ভাই, তাগড়ারে আর ধইরা রাখতে পারলেন না। হালার পো হালায় বেজায়গায় হাত দিছে। বলেই লুঙ্গি গোছ মেরে দাঁড়িয়ে গেল তাগড়া।  সোজা গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এগিয়ে আসা পাক সৈন্যের সামনে। উদোম দেহে দুই সৈনিক খালি হাতে তাকিয়ে আছে একে অন্যের দিকে। দুই পক্ষের বাকি সবাই চুপচাপ দেখতে লাগলো এই দুই পাগলাটে সৈনিকের কান্ড। কেউই কোন গুলি ছুঁড়ল না। তাগড়া এগিয়ে গিয়ে হিংস্র বাঘের মতো সজোরে এক থাবা বসিয়ে দিলো পাক সৈন্যের বুকের বাম দিকে। প্রচন্ড থাবার ধাক্কায় টলতে টলতে পাক সৈন্যটি কোন রকমে আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই প্রতিপক্ষের সৈন্যরা চালিয়ে দিলো গুলি তাগড়াকে লক্ষ্য করে।  গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছিটকে পড়ে গেল তাগড়া। আর পাক সৈন্যটি ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরে তাদের নিজের অবস্থানে।

মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের মাথায় তখন রক্ত উঠে গেছে। প্রবল বেগে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা এগিয়ে গেল শত্রুর  অবস্থানের দিকে। প্রায় বিনা প্রতিরোধেই দখল হয়ে গেল শত্রুর অবস্থান বুহ্য। তারা গিয়ে দেখল প্রায় শতাধিক সৈন্যের মধ্যে কেবল জনা পাঁচেক সৈন্য বাদের বাকি সব পাক সেনা মরে পড়ে আছে। এই মৃতদেহের মাঝেই একদিকে মরে পড়ে আছে সেই পাগলাটে হানাদার সৈন্যটিও। বন্দি সৈন্যরা জানালো, তাগড়ার উপর গুলি চালানোর পর সেই সৈন্যটি  নিজের অবস্থানে ফিরে এসে মেশিনগান নিয়ে উন্মাদের মতো গুলি করে হত্যা করেছে পুরো পাক সেনাদের দলটিকে। খালি হাতে লড়তে এগিয়ে আসা সতী মায়ের দুধ পান করে বড় হওয়া   প্রতিপক্ষের এক যোদ্ধাকে কাপুরুষের মতো এভাবে গুলি করে মেরে ফেলাকে সে মেনে নিতে পারেনি। তাই  অস্ত্র তুলে নিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে নিজের বাহিনীকেই।

নিজের দেশের মাটিতে এসে এক হানাদার পাক সেনার এই দম্ভ মেনে নিতে পারেনি তাগড়া। দেশের সম্মানের জন্য সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। তাই নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও দেশের ও মায়ের সম্মান রাখতে খালি হাতে মল্লযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো তাগড়া। কিন্তু আমরা তাগড়াকে  কোন সম্মান দেখাতে পারিনি। ১৭ই নভেম্বরে তার মৃত্যু দিবস তাই কোথাও পালিত হয় না। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়েও আমদের অনেকেই তাগড়ার এই গল্পের কথা জানতেও পারিনি। আর সেই পাগলাটে পাকসেনার কথা তো বলাই বাহুল্য। নীতি-নৈতিকতার দায়ে যেসব সাহসী মানুষ নিজ দলের বিপক্ষেও অবস্থান নিতে পারে, তারা সব যুগেই অবহেলিত, উটকো ঝামেলার বস্তু। তাই পাকবাহিনীর কাছে হয়তো সে চিহ্নিত হয়েছে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসাবে। একাত্তরে লাখো হত্যা আর নির্মমতার শিকার এই আমাদের কাছে সে স্বাভাবিকভাবেই কেবলই নির্মম হানাদারদের দলের একজন।

বরিশাল অঞ্চলে শর্ষিনার পীর আনুকূল্যে আস্তানা গাড়া হানাদার বাহিনীর হাত থেকে  দেশের মাটিকে মুক্ত করতে কোদালধোয়া এলাকায় সেদিন খালি হাতে উদোম শরীরে মল্লযুদ্ধে এক পাকসেনার মুখোমুখি হয়েছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিনের সেই মল্লযুদ্ধের দুই পাগলাটে যোদ্ধাই আসলে হেরে গেছেন। সেই পাকসেনা নিশ্চয়ই নিজ দেশে  হয়েছে ঘৃণিত। আর দেশের সম্মানে জীবন দেয়া তাগড়াকে আমরাও মনে রাখিনি।  এরা দুজনেই হেরে গেলেও জয়ী হয়েছেন একজন...শর্ষিনার পীর সাহেব। ১৯৮০ সালে শর্ষিনার পীর সাহেবকে  স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার !!
  

বিঃদ্রঃ তাগড়ার এই মল্লযুদ্ধের তথ্য মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা শিরোনামের বই থেকে নেয়া।

১৯ আগ, ২০১৩

বালের রাজনীতি

রাজনীতির ময়দানে চুলোচুলি শুরু হয়েছে। সরকারী দল ও বিরোধী দলের মধ্যে গত দুইদিন ধরে চলছে চুল বিষয়ক তুমুল বাক্য বিনিময়। রাজপথে আমরা দুই দলের নেতা কর্মীদের আগে চুল ধরে টানাটানি করতে দেখেছি। এবার দেখছি রাজনৈতিক সংলাপেও চুল উড়ে বেড়াচ্ছে।

ঘটনার সূত্রপাত ১৮ই আগস্ট ২০১৩ তারিখে। গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা  বলেন, "নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই হবে। সংবিধান থেকে এক চুলও নড়ব না"

পরদিন ১৯শে আগস্ট এর জবাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে  আয়োজিত এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন, "আন্দোলনের বাতাসে চুল উড়ে যাবে। জনগণের আন্দোলনের বাতাসে চুল তো থাকবেই না, সব চুল এলোমেলো হয়ে যাবে"।

এবার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন সরকারের এক মন্ত্রী। ১৯শে আগস্টেই শেখ হাসিনার ধানমন্ডিস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, যারা পরচুলা দিয়ে চুল ফুলিয়ে মানুষকে দেখায় তাদের চুলই উড়ে যাবে।


চুল বা বাল কে কেন্দ্র করে চলমান এই রাজনীতিকেই বোধ হয় বলে বালের রাজনীতি

১৬ আগ, ২০১৩

মুজিব-মোশতাক দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক যোগসূত্র পর্ব-১

খন্দকার মোশতাক আহমেদ...১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত দেশীয় ক্রীড়নকদের অন্যতম।  বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনায় দেশীয় যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই  ১৯৭৫ পূর্ববর্তী বছর গুলোতে এসে এই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত হলেও, খন্দকার মোশতাক এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মোশতাকের বৈরিতার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে একের পর এক সাজিয়ে নিয়ে মুজিব-মোশতাক দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক যোগসূত্রগুলো তুলে ধরাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের এই চরিত্রটি রাতের অন্ধকারে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা কোন চরিত্র নয়। এই রাজনৈতিক সত্ত্বাটি তিলে তিলে গড়ে উঠেছে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ-পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে তিনি ছিলেন একজন দলীয় নেতা। দলের ভেতরে নিজের অবস্থান তৈরি ও টিকিয়ে রাখার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই দলীয় নেতা শেখ মুজিব কে এগিয়ে আসতে হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই তাকে নিজের মত বা দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত অবস্থানে থাকা দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বা দমিয়ে রেখে এগুতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসাবে একই সময়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে এমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তরুণ শেখ মুজিব ও খন্দকার মোশতাক। রাজনীতির দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় শেখ মুজিবের কাছে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন খন্দকার মোশতাক। দলীয় রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়ে খন্দকার মোশতাক যে তার প্রতি অন্তরে এক  তীব্র তিক্ততা ধারণ করেন, তা বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই জানতেন। একারণেই হয়তো স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাককে সরকার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিলেও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধুকে বলতে শোনা যায়, আমাকে যদি কেউ পেছন থেকে ছুরি মারে, তা মোশতাকই মারবে

শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু মোটামুটি একই সময়ে। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে মুসলিম ছাত্র লীগের সংগঠক হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় সহকর্মী হিসাবে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিলেও তাদের মাঝে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল এবং এই মতপার্থক্যের সূত্রপাত ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের মাঝে বিদ্যমান উপদলীয় কোন্দলের মধ্য দিয়ে।  

১৯৪২ সালের দিকে তরুণ শেখ মুজিব যখন গোপালগঞ্জ থেকে পড়াশোনা করতে কলকাতা আসেন, সেই সময়ে ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ছিল দুইটি প্রধান ধারা: একদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন ও মাওলানা আকরাম খাঁ এর নেতৃত্বে দক্ষিণ-পন্থী গ্রুপ এবং অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মধ্যপন্থী গ্রুপ। খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সোহরাওয়ার্দী পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন। আর মুসলিম লীগ দলের ভেতরে নাজিমুদ্দিনের সমর্থিত অংশ থেকে মাওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন সভাপতি আর   সোহরাওয়ার্দী সমর্থিত অংশ থেকে আবুল হাশিম ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

কলকাতায় আসার আগে থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর তুমুল ভক্ত। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন শ্রম-মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ  সফরে এসে শহরের মিশন স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।  বালক মুজিব তখন সেই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল পরিদর্শন শেষে সোহরাওয়ার্দী হাটতে হাটতে লঞ্চ ঘাটের দিকে এগুচ্ছিলেন, তখন অন্য অনেকের মতো শেখ মুজিবও মন্ত্রী মহোদয়কে এগিয়ে দিতে সাথে সাথে হাটছিলেন। তখনই সোহরাওয়ার্দী বালক মুজিবের সাথে প্রথম কথা বলেন এবং তার নাম ঠিকানা লিখে নেন। ঝানু রাজনৈতিক নেতা সোহরাওয়ার্দী...সেই স্বল্প পরিচয়েই  যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। আধুনিক কালে  কোন ইন্টার্ভিউ  কিংবা সভা সমাবেশে পরিচয়ের পর নেটওয়ার্কিং এর উদ্দেশ্যে যেমন থ্যাঙ্ক ইউ নোট পাঠানোর রেওয়াজ চালু আছে, সেই ১৯৩৮ সালেই বালক মুজিবের সাথে সাক্ষাতের পর কলকাতায় ফিরে গিয়েই সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে থ্যাঙ্ক ইউ নোট পাঠিয়ে দেন! এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালে স্কুল ছুটিতে কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে মুজিব সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করেন। সেই থেকেই সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শেখ মুজিবের বাল্যপ্রেমের সূচনা। ফলে মেট্রিক পাশের পর কলকাতায় যাবার পর শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম অংশের সাথে যোগ দিয়ে গিয়ে পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে  ঝাঁপিয়ে পড়েন। সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শেখ মুজিবের এই ভক্তি তার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জীবন জুড়েই বজায় ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই ছিলেন শেখ মুজিবের একক রাজনৈতিক গুরু। বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায়, আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। শেখ মুজিব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে শহীদ সাহেব বলে ডাকতেন।   শহীদ সাহেবের প্রতি তার এই গুরুভক্তি তিনি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিতে কখনো দ্বিধা করতেন না। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক সরকার গঠনের পর মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের সাথে দেখা করতে গেলে গোলাম মোহাম্মদ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, লোক বলে আপনি নাকি কমিউনিস্ট। একথা কি সত্য?। উত্তরে শেখ মুজিব তার  সোহরাওয়ার্দী-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দর্শন জানিয়ে দিয়ে বলেন, যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট। আর যদি শহীদ সাহেব অন্য কিছু হন, তাহলে আমিও তাই

মুসলিম লীগের রাজনীতিতে খন্দকার মোশতাক এবং শেখ মুজিব দুজনেই ছিলেন সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কর্মী। ১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েই দলের ভেতরে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। আবুল হাশিম ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামী দার্শনিক। এই সময়ের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের বাবা তিনি। আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ভেতরে তার ইসলামী সাম্যবাদের  নতুন আর্থ-রাজনৈতিক মেনিফেস্টো দিয়ে তরুণদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগান। সেই সময়ের তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের ভেতর তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। তিনি কলকাতা মুসলিম লীগ অফিসে লাইব্রেরী স্থাপন করে ও কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করে দলে হোল-টাইম ওয়ার্কার বা সার্বক্ষণিক কর্মী প্রথা চালু করলেন। তরুণ শেখ মুজিব কলকাতা মুসলিম লীগ অফিসে হোল-টাইম ওয়ার্কার হয়ে গেলেন। এদিকে আবুল হাশিম পূর্ববঙ্গের জন্য ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে এক তিন তলা বাড়িতে কলকাতার মতোই অফিস স্থাপন করে সেখানেও হোল-টাইম ওয়ার্কার প্রথা চালু করলেন। শামসুল হক (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) ঢাকা অফিসের দায়িত্ব নেন এবং তার নেতৃত্বে অন্য আরও অনেকের মতো খন্দকার মোশতাক ঢাকাতে হোল-টাইম ওয়ার্কারে পরিণত হন। এই সময় আবুল হাশিম কলকাতা ও ঢাকাতে দলের এই সার্বক্ষণিক কর্মীদের তার  ইসলামী সাম্যবাদের নতুন আর্থ-রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর উপরে ক্লাসের আয়োজন করে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতেন। এভাবে শামসুল হক, খন্দকার মোশতাক ও শেখ মুজিবের মতো তরুণেরা আবুল হাশিমের কাছে দীক্ষা নিতে থাকেন। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে অনেক রাত অবধি মাঝে মাঝেই চলতো এই আলোচনা। তবে এই ক্লাসে শেখ মুজিবের মনোযোগ ছিল কম। তার নিজের ভাষায়, আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কষ্টকর। তাই কিছু সময় যোগদান করেই পিছন দিক দিয়ে ভাগতাম। শেখ মুজিব ক্লাসের অন্যদের বলতেন, তোমরা পণ্ডিত হও। আমার অন্য অনেক কাজ আছে,। এভাবেই শামসুল হক ও খন্দকার মোশাতাক  পণ্ডিত হতে হতে আবুল হাশিমের একনিষ্ঠ শিষ্যে পরিণত হন।  শেখ মুজিবের আসল আনুগত্য ছিল সোহরাওয়ার্দীর প্রতি। আবুল হাশিমের ক্লাসের চাইতে রাতের বেলা শহীদ সাহেব এর কাছে গিয়ে রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা নেওয়াতেই তার আগ্রহ ছিল বেশী। অন্যেরা যখন আবুল হাশিমের শিষ্যত্ব বরণ করে নিচ্ছিলেন, সেই সময়েই শেখ মুজিবের কাছে আবুল হাশিমের মূল্যায়ন ছিল এই রকম: আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাকে শ্রদ্ধা করতাম, তাঁর হুকুম মানতাম। হাশিম সাহেবও শহীদ সাহেবের হুকুম ছাড়া কিছু করতেন না। অর্থাৎ, আবুল হাশিমকে তিনি তাঁর নেতা মানেননি। যতদিন আবুল হাশিম সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অনুগত ছিলেন, ঠিক ততদিনই শেখ মুজিবের কাছে তার গুরুত্ব ছিল। আসলে সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শেখ মুজিবের ভক্তি এতই গভীর ছিল যে  সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কার কথা মানা যাবে আর কার কথা মানা যাবে না তা নির্ধারণ করতেন। কেউ সোহরাওয়ার্দীর বন্ধু হলে, তরুণ মুজিব তাকে বন্ধু হিসাবে মেনে নিতেন, আর কেউ সোহরাওয়ার্দীর শত্রু হলে, মুজিবও তাকে শত্রু বলে গণ্য করতেন।  ফলে সে সময়ের অনেক তরুণের মতো খন্দকার মোশতাক আবুল হাশিমের ইসলাম-কেন্দ্রিক দর্শনের প্রতি আনুগত্য গ্রহণ করলেও, শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর পাশ্চাত্য-মুখী মধ্যপন্থী ধ্যান-ধারণার অনুসারী হয়ে থাকেন।

সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের এই যুগলবন্দী টিকে থাকে ১৯৪৬ সালের শেষ দিক পর্যন্ত। এই সময়ে মুসলিম লীগের সভাপতি পদ থেকে মাওলানা আকরাম খাঁ পদত্যাগ করেন। আবুল হাশিম তখন মুসলিম লীগের সভাপতি পদটি গ্রহণ করতে চাইলেন। আবুল হাশিমের এই উদ্যোগে বাধ সাধেন সোহরাওয়ার্দী। মাওলানা আকরাম খাঁ প্রতিপক্ষ খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপের লোক হলেও দলের সর্বস্তরে ছিল তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া সেসময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদ এর সম্পাদক হিসাবেও দেশব্যাপী তার বহুল পরিচিতি ছিল। বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায়, মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেবকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তার বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না। সোহরাওয়ার্দী মাওলানা আকরাম খাঁকে অনুরোধ করে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়ে নেন। ফলে আবুল হাশিম সোহরাওয়ার্দীর উপর দারুণ ক্ষিপ্ত হন। তিনি এতটাই চটেছিলেন যে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা ছেড়ে বর্ধমানে চলে যান। সেই থেকে আবুল হাশিমের সাথে সোহরাওয়ার্দীর দ্বন্দ্বের শুরু। ফলে সোহরাওয়ার্দী-কেন্দ্রিক অবস্থানের কারণে শেখ মুজিবও আবুল হাশিমকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখতে শুরু করেন। তার ভাষায়, আমাদের অনেকেরই মোহ তাঁর (আবুল হাশিম) উপর থেকে ছুটে গিয়েছিলো। ফলে শামসুল হক ও খন্দকার মোশতাকের মতো যারা আবুল হাশিমের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তাদের সাথে শেখ মুজিবের দূরত্ব তৈরির  প্রেক্ষাপটের সূচনা ঘটে এই সময়েই। (চলবে)


(বি: দ্র:  সকল তথ্যসূত্র শেষ পর্বে যোগ করা হবে)

২৩ জুল, ২০১৩

একটু টিপে দিয়েছি

হুমায়ূন আহমেদ এর কোথাও কেউ নেই নাটকের একটি দৃশ্য। এক রিক্সাওয়ালাকে কেন অযথা মারধর করা হলো এই প্রশ্নের জবাবে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বাকের ভাইয়ের উত্তর ছিলোঃ মারলাম কোথায়, একটু টিপে দিয়েছি





সাংবাদিক পেটানোর ঘটনা নিয়ে সাংসদ গোলাম মাওলা রনির নানা নাটকীয় কাণ্ডকারখানা দেখে হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের সেই সংলাপের কথা মনে পড়ে গেল।

২২ জুল, ২০১৩

১৯৭৬-এর রাজনৈতিক দলবিধিতে ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা

১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার এক সপ্তাহ পরই জিয়া দেশে রাজনীতির ময়দান খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন।  তাহেরের ফাঁসির ঠিক ৭ দিন পর ২৮শে জুলাই ১৯৭৬ তারিখে জারি করা হল রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬। এই সামরিক আইন বিধির আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ঘরোয়া পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ করে দেয়া হল। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ও অন্য নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ফলে জাসদ চলে গিয়েছিলো আন্ডারগ্রাউন্ডে। বাকশালে একীভূত হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে মুজিব হত্যা, জেল হত্যা ও মূল নেতৃত্বের কারাবরণ বা আত্মগোপনের ফলে আওয়ামী লীগও তখন নিস্তব্ধ। কিন্তু ১৯৭৬ এর রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় আওয়ামী লীগ ও জাসদ দুটি দলই নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার উদ্যোগ নিলো। জিয়ার সামনে তখন চ্যালেঞ্জ......নিহত শেখ মুজিবের ইমেজ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ও ফাঁসিতে ঝোলানো তাহেরের স্মৃতি সামনে রাখে জাসদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ব্যক্তি ইমেজ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য  জিয়া রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬ জারীর মাত্র সাতদিনের মাথাতেই এই বিধিতে  এক অভিনব সংশোধনী নিয়ে আসলেন। ৪ঠা আগস্ট ১৯৭৬ তারিখে রাজনৈতিক দল বিধি (সংশোধিত সামরিক আইন নং ২৫ ) জারী করে বলা হল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিপূজা প্রকাশ করা হলে তা আইনবর্হিভূত বলে গণ্য হবে। ১৯৭৮ সালের মধ্যেই জিয়া নিজে দেশব্যাপী ব্যাপক ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। জিয়ার নিজের ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহারের সুযোগ এসে যাওয়ায় বিএনপি গঠনের প্রাক্কালে ১৯৭৮ সালের ১লা মে জিয়া সমস্ত সংশোধনী-সমেত রাজনৈতিক দল বিধি ১৯৭৬ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।



রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহারের উপর ১৯৭৬ এর রাজনৈতিক দল-বিধির সেই নিষেধাজ্ঞা টিকিয়ে রাখা ও তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে আজ আওয়ামী লীগ বা বিএনপির রাজনীতির ধরণ কি হতো সে এক কৌতুহলউদ্দীপক প্রশ্ন বটে!   

২১ জুল, ২০১৩

খুনিদের কণ্ঠস্বর

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের দিনের শুরু হয়েছিলো রেডিওতে আমি মেজর ডালিম বলছি ঘোষণা শুনে। সেদিন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এই ঘোষণার কথা পত্রিকায় আর বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছি। আজ সুযোগ হল সেই রক্তস্নাত সকালে রেডিওতে প্রচারিত ঘোষণাগুলোর কিছু অংশ শুনে দেখবার।

 
অডিও ক্লিপটি জুড়ে ঘুরে ফিরে বেজে উঠছিল খুনি মেজর ডালিমের কণ্ঠ। তার দাম্ভিক কণ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করার ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে যাচ্ছিল: বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর, ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইবোনেরা, আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরমদন্ড দেয়া হইবে। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। মেজর ডালিম জনগণকে আরও জানিয়ে চলেছিলেন: আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কোন অসুবিধা নেই।

ফারুক হোসেন নামের বাংলাদেশ বেতারের একজন ঘোষক ও সংবাদ সেদিনের ঘোষণাগুলো সঞ্চালন করছিলেন। তিনি একটু পরপর বুলেটিন পাঠ করে জানিয়ে যাচ্ছিলেন: শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো...সারা বাংলাদেশে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করা হইয়াছে।

মাঝে জাতীয় সংগীতের সুরে বাজিয়ে জানানো হয় এখন বক্তব্য রাখবেন, আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। প্রেসিডেন্ট সাহেব জাতিকে আসসালামাইকুম জানিয়ে বলেন, এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আজ দেশ এবং দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহ-তায়ালা ও দেশবাসীর উপর নির্ভর করে  তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তিনি আরও জানান, দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী বীরের মতো তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।

দিনভর বাংলাদেশ বেতারের সব বুলেটিন ও সংবাদ খন্দকার মোশতাকের সেই ভাষণের উপর ভিত্তি করে জানিয়ে চলে: খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আজ ভোরে সামরিক বাহিনী দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। সব দেশপ্রেমিক নাগরিককে নতুন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। বিশেষকরে রক্ষীবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশ বাহিনীকে  নিকটস্থ সামরিক কমান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। নতুন সরকার সারা বিশ্বের প্রতি তাকে স্বীকৃতি দানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল-সন্ধ্যা কারফিউ জারী করে রেডিওতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যাতে কেউ পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়ী ঘর থেকে বের না হয়। তবে দুপুরের আগে আগে সংবাদে জানানো হয়, জনগণ যাতে জুম্মার নামাজ আদায় করতে পারেন সেজন্য রাষ্ট্রপতি আজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এর মাঝে রেডিওতে হুবহু একি বক্তব্য এক এক করে পাঠ করে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌ বাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল একে খন্দকারসহ পুলিশ ও বিডিআর প্রধানেরা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাদের সবার দুই বাক্যের সেই ভাষণ ছিল এরকম:  দেশের নতুন সরকারের প্রতি আমরা আমাদের অবিচল আস্থা ও আনুগত্য জ্ঞাপন করছি। আমাদের সকল পর্যায়ের অফিসার ও জওয়ানদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ কমান্ডারদের নির্দেশ অনুযায়ী স্ব স্ব দায়িত্বে নিযুক্ত থাকার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে ......এই নির্মম বাক্যটি কি অবলীলায় সবাই মিলে সেই জাতীয় প্রচার মাধ্যমে উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন!!

২০ জুল, ২০১৩

অযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য

পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে কিংবা পালিয়ে গিয়ে যেসব বাঙ্গালী সেনাসদস্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তারা সকলেই সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের শপথ বরখেলাপ করেছেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে তারা যতই বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিক না কেন, স্বাধীনতার পরে তাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকুরীতে ফিরিয়ে আনা ঠিক হয়নি। কারণ শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের শপথ ভঙ্গের দায়ে এই সকল মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য সেনাবাহিনীতে যোগদানের অযোগ্য হয়ে গেছেন।


গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ গ্রন্থে এই বক্তব্য প্রকাশ করেছেন মওদুদ আহমেদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আনুগত্য বজায় না রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কারণে মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ফিরে আসার অযোগ্য। তার মানে কি এই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে বাঙ্গালী নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা সেনাবাহিনীতে ফিরে আসার যোগ্য থাকতেন?

গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ বইয়ের পৃষ্ঠা ১০-এ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে নানা বিশৃঙ্খলার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মওদুদ আহমেদ লিখেছেন:

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে সমস্ত ব্যাটালিয়ন স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল কেন্দ্রগুলো গঠন করে তারা সবাই ছিল মূলত পলাতক। সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবার সময় আনুগত্যের একটি শপথ নিলেও তারা সেই শপথ ভেঙ্গে মূল সেনাবাহিনীর কমান্ড ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিল। যুদ্ধকালে যত বীরত্ব ও সাহসিকতাই তারা প্রদর্শন করে থাকুক না কেন, অপর একটি সুশৃঙ্খল চিরায়ত সেনাবাহিনীর সদস্য হবার জন্য আনুগত্যের যে যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, সে যোগ্যতা হারিয়ে ফেলায় ইতোমধ্যেই তারা হয়ে পড়েছিলো অযোগ্য। বীরত্ব ও ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের বেসামরিক প্রশাসন, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও অঙ্গীভূত করা যেতো, কিন্তু কোনভাবেই তাদের সুশৃঙ্খল একটি সেনাবাহিনীর ধাপক্রমিক পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা উচিত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

১৫ জুল, ২০১৩

গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে


পঞ্চগড় থেকে ঘুরে এলাম। পঞ্চগড়ের ভেতরগড়-অমরখানা-জগদলহাট-বেরুবাড়ি-সোনারবান-নালাগঞ্জ-সর্দারপাড়া-মহারাজদীঘি-তলমা নদীর পাড়...এসব এলাকায় একাত্তরের এক গেরিলা দলের সাথে কেটেছে আমার গত কয়েকটি রাত। মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে এত কাছ থেকে দেখার দেখার, মুক্তিযুদ্ধের গণ-চরিত্রকে এভাবে অনুভব করার সুযোগ এর আগে আমি আর কখনো পাইনি। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহবুব আলমের গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে নামের প্রায় ১২০০ পাতার বইটি আমাকে এই অনন্য অভিজ্ঞতার মধ্যে নিয়ে গেছে। আমার সীমিত পড়াশোনায় এটি মুক্তিযুদ্ধের উপর এযাবৎ কালের শ্রেষ্ঠতম বই। নির্দ্বিধায় আবারো বলছি, মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার পড়া শ্রেষ্ঠতম বই।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুরসহ শ্রেণীগোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে গণযুদ্ধের রূপ নিয়েছিলো, তার বর্ণনা এই রকম সামান্য কিছু বাক্যেই শেষ। মুক্তিযুদ্ধের গল্পে-ইতিহাসে আর বাকি সবই সামরিক বাহিনীর তৎপরতা আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কর্মকাণ্ডের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। সাহিত্য-প্রকাশ থেকে প্রকাশিত মাহবুব আলমের গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে বইটি এই সকল সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগহণের ছবিটি দারুণ ভাবে তুলে এনেছে। সেই ১৯৯১ সালে প্রকাশিত বইটি, এই রত্নটি কিভাবে এতকাল আমার চোখের আড়ালে রয়ে গেল...সেটাই এক বিস্ময়।

১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের ছাত্র রংপুরের ছেলে মাহবুব আলম। যুদ্ধের সময় এক গেরিলা দলের কমান্ডার হিসাবে তাকে সপ্তাহে দুইবার তার দলে তৎপরতার রিপোর্ট করতে হতো। সেই রিপোর্টিংয়ের জন্য তার নোটবুকে তিনি কয়েক লাইনে টুকে রাখতেন প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা। এরকম তিনটি ফিল্ড বুকের উপর ভিত্তি করে স্মৃতি থেকে তিনি তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের এর অবিশ্বাস্য চিত্র...যার পুরোটা জুড়েই আছে একবারে সাধারণ মানুষের শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের সম্মিলিত যুদ্ধের কথা, যুদ্ধে গ্রামের গণ-মানুষের অংশগ্রহণের পুঙ্খানুপুঙ্খ জীবন-ঘনিষ্ঠ বর্ণনা।


আমাদের চেনাজানা বন্ধু মহলের সবার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ...এখনো যারা পড়ে দেখেননি...অবশ্যই পড়ে নিবেন। এখুনি। দেশে বইয়ের দোকানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। বিদেশে যাদের সহজে বাংলা বই হাতে পাবার সুযোগ নেই, ইন্টারনেটে খুঁজলে তারাও পিডিএফ আকারে পেয়ে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধকে এক নতুন ভাবে অনুভবের সুযোগ এনে দিবে এই বইটি। পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে দেখবেন পিন্টু-মতিয়ার-মধুসুদন-জহিরুল-অহিদার-গোলাম গউস-হাসান-আক্কাস-একরামুল-মজিব-দুলু-মন্টু-বাবলু-মুকতু মিয়া-জোনাব আলী-হাসান মাঝি এসব গণমানুষের চরিত্রগুলো অজান্তেই কখন যেন কত আপন হয়ে যায়। কর্নেল-ক্যাপ্টেন-মেজরদের মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি আপনি এসব গন-যোদ্ধাদের মধ্যদিয়ে দেখতে পাবেন এক জনযুদ্ধের রূপ।

১৩ জুল, ২০১৩

সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে একটি প্রশ্ন: একজন মুক্তিযোদ্ধা পিতা বা মাতার সংসারে যদি ৫ জন ছেলে মেয়ে থাকে, সেই ৫ জনের প্রত্যেকেই কি মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পাবে? একটি পরিবারে কতজনকে পুনর্বাসিত করলে একটি পরিবার পুনর্বাসিত হয়?

সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার উদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পুনর্বাসন। সেই উদ্দেশ্যে বর্তমানে সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য সংরক্ষিত আছে ৩০ ভাগ কোটা। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পুনর্বাসন জরুরী। তবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ কতটা অযৌক্তিক? সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লক্ষ ৬ হাজার। ১৬ কোটি মানুষের দেশে এই মুক্তিযোদ্ধাদের অংশ শতকরা দশমিক এক দুই ভাগ (০.১২ ভাগ)। অর্থাৎ চাকুরীতে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় ২৪০ গুন বেশী।


এই কোটার সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করা দরকার। একইভাবে দরকার এক পরিবারে সর্বোচ্চ কতজন কোটার সুবিধা পাবে তার সীমা নির্ধারণ।

পার্মানেন্ট ডিলে

Permanent Delay কথাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। এই শব্দ-যুগলের সৌন্দর্য Temporarily Killed শব্দ-যুগলকেও হার মানায়!

সব রিপাবলিকান সিনেটর এক যৌথ চিঠি পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে হেলথ কেয়ার রিফর্ম অ্যাক্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে Permanently Delay করার আহ্বান জানিয়েছেন। কংগ্রেস ও সিনেটে হেলথ কেয়ার রিফর্ম বিলটির পাস হওয়া ঠেকানো যায়নি। এরপর সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে আইনটিকে অসাংবিধানিক হিসাবে বাতিল করার চেষ্টাও সফল হয়নি। শেষে এই আইনটি প্রত্যাহার করার নির্বাচনী মেনিফেস্টো নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করেও জুটেছে ব্যর্থতা। তাই এখন সিনেট রিপাবলিকানদের এখন নতুন আবদার, ঠিক আছে, মেনে নিলাম আইন, তবে এর বাস্তবায়নে চাই Permanent Delay


এখন কায়দা করে এই নিউজটা দেশে মওদুদ আহমেদের হাতে ধরিয়ে দিতে পারলে দেখা যাবে বিএনপিও এর প্রয়োগ শুরু করেছে... ঠিক আছে, মেনে নিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আইন, তবে বাস্তবায়নে চাই Permanent Delayআফটার অল, আদালতের রায়ে দুই মেয়াদের বা ১০ বছরের Delay করার কথা বলা ছিল।

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েই চলেছে!

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে এই পর্যন্ত মোট পাঁচ বার। এই হলো গণনার ফলাফল:
১৯৭৩ সাল: ৬৯,০০০ জন
১৯৮৬ সাল: ১,০২,৪৫৮ জন
১৯৯৬ সাল: ১, ৫৪, ০০০ জন
২০০১ সাল: ১, ৯৬, ০০০০ জন
২০০৯ সাল: ২, ০৬,০০০ জন

যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েই চলেছে!