১৮ অক্টো, ২০১১

প্রতিশোধ


উপরের স্কোরকার্ডটা আজকের (২০১১ সালের ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচ) ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৬১ রানে অল আউট হবার ইনিংস। নীচের স্কোরকার্ডটা ২০১০ সালে ঢাকাতে ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ৫৮ রানে অল আউটের ইনিংস। দুটি স্কোরকার্ডেই সর্বোচ্চ রান ২৫, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১, এরপর ৮, এরপর ৫ এবং এরপর ৪......কি ভয়াবহ মিল !! প্রতিশোধ একেই বলে !



১৯ সেপ, ২০১১

ভূমিকম্পে ঘরে না বাইরে থাকবেন?



আজ সকালে (আমেরিকার সময় ১৯শে সেপ্টেম্বর সকাল) বাংলাদেশে তীব্রমাত্রার ভূমিকম্পের খবর পেয়েই বাংলাদেশের টিভি চালিয়ে দেখলাম ভূমিকম্পে আতঙ্কিত মানুষের বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তার নেমে আশ্রয় নেয়ার খবর। ফোনে দেশে বিভিন্ন জায়গায় পরিচিতজনের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বাসা-রাস্তা-বাসা রাউন্ড ট্রিপ দৌড়াদৌড়ি শেষে সবাই এখন নিরাপদে নিজ গৃহকোণে ফিরে এসেছে। দেশে ছোটবেলায় আমারও এমন বেশ কয়েকবার ভূকম্পনজনিত দৌড়াদৌড়ির অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভুমিকম্প মানেই ছিল রাতবিরাতে লম্ফঝম্ফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা। তবে সময়ের সাথে মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে আর তার স্বাক্ষর হিসেবে এবার কিছু ব্যতিক্রমও এবার দেখলাম। যেমন একবন্ধু ভুমিকম্প চলাকালে দৌড়াদৌড়ি বাদ দিয়ে ছিল ফেসবুকে লাইভ আপডেট দেয়ার কাজে ব্যস্ত । আবার অন্য এক বুদ্ধিমতী তরুণী ভূমিকম্প শুরু হবার সাথে সাথেই শুরু করেছিল বাসার ছাদ অভিমুখে বিপরীতমুখী যাত্রা। চারিদিকে বহুতল ভবন ঘেরা নাগরিক জঙ্গলে নিচে নেমে আসার চাইতে তার উপরে উঠে যাওয়াই নিরাপদ মনে হয়েছিল! তবে এই রকম প্রতিভা এখনো দেশে বিরল। প্রায় সবাই এখনো ঘর ছেড়ে বাহিরে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার কৌশলই আঁকড়ে রেখেছে। কিন্তু ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসা কি আসলেই নিরাপদ?

এ বিষয়ে একটু খোঁজ খবর করে যা জানা যাচ্ছেঃ ভূমিকম্পের সময় আমাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসাটাই স্বাভাবিক প্রবণতা হলেও বিশেষজ্ঞদের মতামত কিন্তু এর উলটো। গবেষনায় দেখা গেছেঃ ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়েই মানুষ দেয়ালে চাপা পড়ে বা উপর থকে পড়ন্ত বস্তুর আঘাতে সবচেয়ে বেশী হতাহত হয়। তাই রেডক্রস ও উন্নত বিশ্বের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা সহ সরকারী-বেসরকারী নানা সংগঠন এখন ভুমিকম্পের সময় আত্মরক্ষার জন্য ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন নামের একটি উপায়কেই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে মনে করে। ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমিকম্প অনুভূত হবার সাথে সাথেই বসে পড়ে (ড্রপ) টেবিল, বিছানা বা আসবাবপত্রের মতো মজবুত জিনিসের নিচে আশ্রয় নিয়ে (কাভার) সেই জিনিসটিকে অর্থাৎ টেবিল বা আসবাবপত্রের কোন অংশ শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হবে (হোল্ড অন) ।. এসময় ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করাটা বিপদজনক। অতীতে ঘটে যাওয়া নানা ভূমিকম্পে জীবনহানির কারন বিশ্লেষনে দেখা যায় ঘরের দরজা আর বহির্মূখী দেয়াল ভেঙ্গেই বেশীর ভাগ সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়া উপর থেকে পড়ন্ত ভারী বস্তু কিংবা ধারালো জিনিসের আঘাতে আহত বা জীবন হারানো আশঙ্কা থেকে থাকে। যেমন ১৯৩৩ সালে দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত ১২০ জনের অধিকাংশই মারা গিয়েছিল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘরের বহির্মূখী দেয়ালের ধ্বসে চাপা পড়ে।

আমেরিকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা ফেমার ওয়েবসাইটে ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ের একটি সুন্দর তালিকা দেয়া আছে। ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষার উপায় সম্পর্কে খোঁজ-খবর করলে বিভিন্ন সংগঠনের ওয়েব সাইটেও মূলত এই একই রকম পরামর্শ পাওয়া যাবে। এই পরমর্শগুলোর বেশীর ভাগই ক্যালিফোর্নিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত গবেষনার ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছেঃ ভূমিকম্পের সময় যদি আপনি নিজ বাসার বা অন্য কোন ভবনের ভিতরে থাকেন তাহলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন না। ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন পদ্ধতিতে মজবুত কোন কিছুর নিচে সাথে সাথে আশ্রয় নিন। যদি মজবুত কোন কিছুর নিচে আশ্রয় নেয়ার উপায় না থাকে, তবে মাথা ও মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে ঘরের অভ্যন্তরের কোন দেয়ালের কোণে (যেমন দুই রুমের মাঝের দেয়ালের কোণ) কুঁকড়ে বসে পড়তে হবে। কোন অবস্থাতেই জানালা, কাঁচের জিনিসপত্র ও বহির্মুখী দেয়ালের কাছে থাকা যাবে না। এছাড়া উঁচু ভারী জিনিস যেমন আলমারী, বইয়ের তাক ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ভূমিকম্পের সময় যদি আপনি বিছানায় শোয়া অবস্থায় থাকেন এবং মূহুর্তের মধ্যে ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন অবস্থানে যাওয়া না যায়, তাহলে বালিশ জাতীয় কিছু দিয়ে মাথা ঢেকে বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকতে হবে। তবে বিছানার উপরে যদি সিলিং ফ্যানের মতো ভারী কিছু থাকে, তাহলে বিছানা থেকে অবশ্যই নেমে পড়তে হবে। ভূকম্পন পুরোপুরি থেমে না যাওয়া পর্যন্ত ঘরের ভিতর নিরাপদ অবস্থানে বসে থাকতে হবে। ভুমিকম্পের সময় ঘরের ভেতরে হাঁটাচলা ফেরা করাও বিপদজ্জনক। ঘরের ভেতরে নিরাপদ অবস্থান বেছে নিয়ে সেখানেই বসে থাকুন। ভূকম্পনের সময় কেবল ১০ফুট দুরত্ব অতিক্রম করলেও হতাহত হবার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই যত কম দুরত্বের মধ্যে নিরাপদ অবস্থান নিতে হবে। ভূমিকম্পের সময় যদি আপনি ঘরের বাহিরে অবস্থান করেন তাহলে ঘরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবেন না। ভূমিকম্পের সময় ঘরের বাহিরের দেয়াল বা প্রবেশ পথ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। যথাসম্ভব খোলা জায়গায় বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকুন। অন্য বিল্ডিং, দেয়াল, রাস্তার বৈদ্যুতিক তার বা বাতির কাছ থাকে দূরে থাকুন।



ইদানিং ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন পদ্ধতির বিপরীতে ট্রায়াঙ্গাল অব লাইফ নামের একটি বিতর্কিত আত্মরক্ষার পদ্ধতি ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই মতানুসারে টেবিল, বা আসবাবপত্রের মতো মজবুত জিনিসের নিচে আশ্রয় না নিয়ে বরং সেটার পাশে অবস্থান নিতে হবে। দেয়াল বা ভবন ভেঙ্গে পড়ে টেবিল বা আসবাবপত্র ভেঙ্গে গেলেও সেটার পাশে একটা ত্রিভূজাকৃতির ফাঁকা স্থান তৈরী হয়। এই ত্রিভূজাকৃতির ফাঁকা স্থানটার নামই হলো ট্রায়াঙ্গাল অব লাইফ যা ভূমিকম্পের সময় দেয়াল বা ভবন ধ্বসের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে যথাযথহ নির্মাণ নীতিমালা মেনে ঘর বাড়ি তৈরী হয় যেখানে না আর তাই দেয়াল বা ভবন ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা থাকে বেশী। দাবী করা হয় এসব ক্ষেত্রে ট্রায়াঙ্গাল অব লাইফ পদ্ধতি নাকি বেশী কার্যকর। তবে রেডক্রস এবং সরকারী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলো ট্রায়াঙ্গাল অব লাইফ পদ্ধতিকে স্রেফ ভাওতাবাজী ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বলে গন্য করে।

উন্নত বিশ্বে আধুনিক নির্মান প্রযুক্তি ও ভবন নির্মান নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ ভূমিকম্পের সময় ভবন সম্পুর্ন ধ্বসে পড়ার ঝুঁকি একেবারেই কমিয়ে ফেলেছে। এসব দেশের সুঠাম ভবন কাঠামোর ভিতরে অবস্থান করে ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন পদ্ধতি অনুসরন করা ভুমিকম্পের সময় আত্মরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর পথ হতে পারে কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে বের না হওয়া এবং বাহিরের থেকে থাকলে ঘর বা কোন ভবনে ঢোকার চেষ্টা না করার এই পাশ্চত্য পরামর্শ কি আমাদের মতো দেশে প্রযোজ্য? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাড়ি নির্মাণের যথাযথ নীতিমালা অনেকক্ষেত্রেই মানা হয় না। বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভবন নির্মান নীতিমালা আধুনিকায়ন ও সংশোধন করা হয় ১৯৯৩ সালে। তবে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এর যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভবন নির্মান নীতিমালা প্রনয়নের আগে তৈরী অসংখ্য পুরোনো বা ঘরবাড়ী। ২০০৮-৯ সালে খাদ্য ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের জরীপে দেখা গেছে শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৭৯ হাজার ভবন রয়েছে যা ৬-মাত্রার মাঝারী মানের ভুমিকম্পে সামাল দিতে অক্ষম। এই অবস্থায় আমরা ঘরের বাইরে আসবো না ভিতরে থাকবো?

ভারত সরকার ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে ভারতের শহরগুলোতে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের জন্য গৃহিত কর্মসূচীর আওতায় ভুমিকম্পের সময় করণীয় হিসেবে ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়। বাংলাদেশের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর ভূমিকম্প বিষয়ে গণসচেতনতা বুকলেটও ঘরের ভেতরে মজবুত জিনিসের নিচে আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়। ১৯শে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিবেদনে নগর ঝুঁকি হ্রাস বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামালও ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতরে থাকার পরামর্শ দেন। তার মতে আমাদের উচিত ভূমিকম্প চলাকালে ঘর থেকে বের না হয়ে কলাম ও বিমের সংযোগস্থলের কাছাকাছি অবস্থান নেওয়া। অথবা দরজার চৌকাঠের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা। ঘরে শক্ত টেবিল থাকলে তার পায়া ধরে নিচে গিয়ে বসে থাকা। কম্পন শেষ হওয়ার পরে ঘর থেকে বের হয়ে খোলা মাঠে কিংবা নিরাপদ জায়গায় যাওয়া। তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের অধিকাংশ অফিস-আদালত ও বাসাবাড়ি থেকে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ সিঁড়ি দিয়ে বাইরে নেমে এসেছে। মাঝারি বা তীব্রতর ভূমিকম্পই হোক না কেন, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে আসা ঠিক নয়। এভাবে মাঝারিমাত্রার ভূমিকম্পে ভবন ভেঙে পড়ে না। কিন্তু এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। ২০০১ সালে ঢাকার অদূরে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামার সময় প্রায় ১০০ জনের মতো কয়েদি আহত হয়েছিল। আবার ২০০৮ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় ৪.৫ মাত্রায় ভূমিকম্পের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে নামতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছিলেন।

দেখা যাচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের মতামত ভূমিকম্পের সময় ঘরে অবস্থানের পক্ষে। এর যৌক্তিকতা গতকালের টিভি রিপোর্টে সাধারন মানুষের মতামতের মধ্যেই ফুটে উঠতে দেখেছি। এক মহিলাকে বলতে শুনলাম বাসা থেকে বেরিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করাও উনি ভবন-দূরবর্তী কোন খোলা জায়গা খুজে পাননি। ইটকাঠের জঙ্গলে ঢাকা শহরে এমন খোলা জায়গা আসলেই দুর্লভ। এছাড়াও আছে মাথার উপরে খোলা বৈদ্যুতিক তারের মরণ ফাঁদ। স্বাভাবিক সময়েই নির্মানাধীন ভবন থেকে ইট খুলে পড়ে যেখানে রাস্তায় পথচারীর মৃত্যু হয়ে, সেখানে ভূমিকম্পের প্রলয়লীলা ঘটলে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নামে আসা মানুষের ভাগ্যে যে কি ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভুমিকম্পে বাড়ির দেয়াল ধ্বসে পড়লেও ঘরের ভেতরই হতাহত হবার ঝুঁকি থাকবে তুলনামূলক ভাবে কম।

ঝড়, বৃষ্টির, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগে আমরা ঘরে ফিরে আসি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃংখলার মাঝেও নিজ গৃহকোণ হয়ে উঠে অনেকের নিরাপত্তার প্রতীক। কিন্তু আমাদের পায়ের নিচের মাটিও যখন আক্ষরিক অর্থে কেঁপে উঠে ভূমিকম্পের আঘাতে, সেই চিরচেনা আশ্রয়ের জায়গাটিকে ভূলে যাবেন না। নাগরিক জীবনের এই ইট-কাঠের জঙ্গলে ভূমিকম্পের সময় ঘরে থাকুন। 

ভূমিকম্পের সময় বাড়িতে থাকবেন না বেরিয়ে আসবেন?
৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১১
নক্সভিল, টেনেসি
সচলায়তন ব্লগে
 প্রথম প্রকাশিত



১২ ফেব, ২০১১

স্বাগতম, হে ভারতীয় ক্রিকেট দল


হাতে লেখালেখির সময় কম। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন সাইটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার পুরানো লেখাগুলো নিজের এই ব্লগের জড়ো করছি। নিচের রম্যগদ্যটি বাংলাদেশে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর দিন কয়েক আগে খেলা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তখন খুব সাজ সাজ রব। আয়োজক কর্তৃপক্ষ দেশের দারিদ্রের সব চিহ্ন বিশ্বকাপ উপলক্ষে আগত অতিথিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে জন্য নানা কসরত করেছে। রাজপথের পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা বস্তি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। পথের পাশা দিয়ে বয়ে চলা ময়লা নর্দমা রাস্তার দু-পাশে পর্দা টানিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। মুল সড়ক গুলো থেকে হকার ও ভিখিরিদের ঝাটিয়ে খেদানো হচ্ছে। এই সাজ-সজ্জার উৎসবে আমরা সবাই সাড়া দিয়েছিলাম বিপুল উদ্দীপনায়। একটি মাসের জন্য আমরা ভুলে যেতে চাইলাম না-পাওয়ার সব হাহাকার। ক্রিকেট দলকে নিয়েও আমাদের আশা তখন সীমাহীন। সেই পটভূমিতেই তৈরি এই লেখাটি।


স্বাগতম, হে ভারতীয় ক্রিকেট দল, বাংলাদেশের মাটিতে আপনাদের সুস্বাগতম। 
অনুগ্রহ করে আপনারা বাংলাদেশে আপনাদের পদধূলি দিয়েছেন, সেই জন্য আমরা বড়ই আহ্লাদিত। আপনারা পাড়ার বড় ভাই, গরীবের মাঠে এসে খেলবেন- এ যে আমাদের জন্য কি সম্মান তা বলে বুঝানো যাবে না। আপনাদের রাজবাড়ীতে গত বারো বছরে একবারও নেমতন্ন না পেলেও আমরা মাইন্ড খাইনা। আমাদের সীমান্ত-কন্যা ফেলানীকে কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় গুলি করে মেরে ফেললেও আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুশীতে বগল বাজাই আপনাদের সরি শুনেই। কারণ মানী লোকের মান আমরা বুঝি। সম্মানী লোকের সাথে কিভাবে সম্ভ্রম আর বিনয়ের সাথে ব্যবহার করতে হয়, তা আমরা জানি। আর আমরা জানি বড়লোকের চলাফেরা হয় বড়লোকের সাথে এবং ধনীর বাড়িতে ধনীর আগমনই শোভা পায়। আপনারা যে আমাদের ভাঙ্গা দুয়ারে এসেছেন, তাতেই আমরা আনন্দে আটখানা। আপনাদের আদর, আপ্যায়ন, আদর, সমাদরে আমরা কোন কমতি রাখবো না। দেশবাসীর পক্ষে বিনম্র চিত্তে, হে ভারতীয় দল, আপনাদের জানাই সশ্রদ্ধ সম্ভাষণ।

আপনাদের এবং আরও বিদেশী অতিথিদের সমাদরের জন্য আমরা চেষ্টার কমতি রাখি নাই। চট্টগ্রামে রাস্তার পাশের বস্তি ভেঙ্গে সব নোংরা আদমি লাথি মেরে ভাগিয়ে দিয়েছি। পচা আবর্জনা, নর্দমা এসব দেখে আপনাদের সুবাসিত মুড যাতে যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, সেজন্য যোজন যোজন পথ আমরা সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ঢেকে দিয়েছি। আপনাদের মনের বলিউডি সৌরভ যাতে ফিকে না হয়, সে জন্যে ঢাকা শহর থেকে ভিখারি ঠেঙ্গিয়ে আমরা বিদায় করেছি। বাড়ীর মালিক আর গাড়ীর মালিক সবাইকে বলে দিয়েছি রঙ মাখিয়ে সব ফিটফাট করে ফেলার জন্য। এখন শুধু বাকি রেখেছি আপনাদের সফরের সময় লুঙ্গী পড়া নিষিদ্ধ করতে আর মানুষকে শার্ট-প্যান্ট ইন করে চলাফেরায় বাধ্য করতে। আপনারা চাইলে বিশ্বকাপের সময় মহিলাদের বিশেষ তারযুক্ত ব্রা পড়াও বাধ্যতামূলক করে দিতে পারি, যাতে সুউচ্চ বক্ষ-যুগল আমাদের উন্নয়নের গ্রাফটা ঠিক মতো তুলে ধরতে পারে। মোদ্দা কথা, আপনাদের স্বাগত জানানোর জন্য আমরা চেষ্টা-চরিত্রের কিছু বাকি রাখি নাই।

তবে কিনা ইয়ে, আমাদের ক্রিকেট দলের পোলাপান গুলোকে আমরা এখনো ঠিক মতো আদব কায়দা শিখিয়ে উঠতে পারি নাই। বুঝেনই তো এই যুগের বখে যাওয়া পোলাপান...বড্ড বেয়াদব। আদব সম্ভ্রম রেখে কথা কইতে জানে না। তাই আগে ভাগেই আপনাদের একটু ভেতরের খবর জানিয়ে রাখি। মাঠে যদি এরা কোন বেয়াদবী করে ফেলে, আমাদের মাফ করবেন।

আর বলবেন না...এদের নিয়ে আর পারি না। এই যে ধরেন সেদিনকার পোলা তামিম। বেয়াদবের এক শেষ। আপনাদের সম্মানের কপালে হিসি করে দিয়ে দেখবেন হয়তো ধুরুম ধারুম করে ব্যাট চালানো শুরু করবে। ২০০৭-এ জহির খান সাহেবের মতো মানীগুণী মানুষকে চোর মারার মতো বাইন্ধ্যা ধইরা পিটালো। এ ছেলে এই কবছরে আরও বখে গেছে। মাইরের উপর এর আর কোন কথা নাই। এই বখাটে ছেলের ব্যবহারে দয়া করে কিছু মনে নিবেন না। কথায় বলে, সঙ্গদোষে স্বভাব নষ্ট। বেয়াদপ তামিমের লাই পেয়ে পেয়ে ইমরুলের মতো ভদ্র ছেলেও এই কবছরে বখে ভীমরুল হয়ে গেছে। এর সাথে আরও আছে জুনায়েদ, নাফিস এগুলা। ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাটিং করতে এসে ফাল দিতে এরাও কম যায় না।

ভারতকে ধরে দিবানি বলে আরেক বদমাশ মাশরাফী আপনাদের ২০০৭-এ ঠিক জায়গা মতো ভরে দিয়েছিল। অসভ্যের এক শেষ। তবে মানীর মান আল্লাহ রাখে...এই বদমাশ এবার মাঠের বাইরে। কিন্তু এই কলি কালে দুশমনের কি অভাব আছে। কোথাকার কোন কাইল্যা রুবেল, চিকনা সফিউল, পাতলা নাজমুল...সবগুলো বেত্তমিজ কিন্তু একসাথে গ্যাং বানিয়েছে। শোনা যায়, কোন এক ফিরিঙ্গি কোচ ইয়ান পন্টের পাল্লায় পড়ে এরা নাকি হয়েছে আরও ডেয়ারিং। বাটার-ফ্লাই নামের কি এক যেন বোলিং নিয়ে এরা দিনভর এখন কেবল শ্রী শ্রী প্রজাপতেয় নমঃ বলে চিল্লা ফাল্লা করে। বলে কিনা, প্রজাপতি এবার রেডি, ভারতের সাঙ্গা হবে সাঙ্গা

আরও আছে বিশ্বসেরা রংবাজ মাগুরার পোলা সাকিব। দেখতে ভদ্র লাগে, আসলে কিন্তু মিচকা শয়তান। এইটাই হলো পালের গোদা। এর পিছে পিছে ঘুরে নাসিকা-উস্ফলিত রাজ্জাক, সারাক্ষণ যেন উইকেটের গন্ধ শুকে বেড়ায়। স্পিনের আসর বসিয়ে আপনাদের মান-সম্ভ্রমকে এরা নাচের বাইজী বানিয়ে নাচানোর ফন্দি ফিকির করতে পারে। একটু দেখে শুনে চলবেন কিন্তু।

সাঙ্গপাঙ্গের কিন্তু এখানেই শেষ না। একদল আছে ফিল্ডিং এর সময় চক্কর মারে। ফিরিঙ্গি কোচ জুলিয়ান ফাউন্টেইন নাকি এদের দিয়ে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বানিয়েছে। এই কালপ্রিট দলেই আছে শুভ্র নামের ফটকা মৌলভী। লেবাস দেখে কিন্তু ভুল করবেন না। দাড়িওয়ালা-টুপিপড়া এই জঙ্গি যদি ফিল্ডিং এর সময় বল হাতে পেয়ে ওটাকে বোমা মনে করে বসে, তাহলে আল্লাহ মালুম, আপনাদের উইকেট, টুইকেট উড়িয়ে কিন্তু জিহাদ শুরু করে দিতে পারে। দয়া করে প্লিজ রান নিবেন খুব খেয়াল কইরা

পুরানা ফটকাবাজ আশরাফুল তো আছেই...সারাক্ষণ খালি দে উপ্তা কইরা দে বলে ফাকা আওয়াজ ছুড়ে। সম্ভ্রান্ত লোকজনের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, এত দিনেও ঠিক মতো শিখে নাই। আর আছে উইকেটের পিছনে মুশফিক নামের ধাইন্যা মরিচ। সারাদিন খালি প্যাক-প্যাক, প্যাক-প্যাক করতেই থাকে। আদব-কায়দার কোন বালাই নাই।

হঠাৎ ফোনের রিং...ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ভারতীয় অতিথিবৃন্দ, একটু প্লিজ, ফোনটা রিসিভ করি। হয়তো আপনাদের জন্য আরও নতুন আদর-আপ্যায়নের আয়োজনের খবর আসছে।

- হ্যালো?

- হ্যালো বাবু ভাই? আমি মুশফিক, ধাইন্যা মরিচ।

- আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আপনি অনেক দিন বাঁচবেন, আপনার কথাই লিখছিলাম

- হ্যাঁ, শুনলাম আপনি নাকি ভারতকে স্বাগতম জানিয়ে লেখা লেখতেছেন, তাই নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিলাম

- হ্যাঁ, তা তো লিখছি। আপনার কিছু দরকার?

- হ্যাঁ, সেই স্বাগতমের লেখায় একটা জিনিস একটু লিখবেন। আমাদের সাথে ভারতের খেলা কিন্তু এবার শনিবার। ওদের একটু কইয়্যা দিয়েন, ভারতের কপালে এবার শনিই আছে

ফোন রেখে দিলাম। দেখলেন তো কান্ড। কি আর বলার আছে। আমাদের মতো নম্র-ভদ্র মানুষের মধ্যে এই সব বেত্তমিজ পোলাপান যে কিভাবে পয়দা হলো, সেই চিন্তায় আছি।

হে সম্মানিত ভারতীয় ক্রিকেট দল, বাংলাদেশে আপনাদের স্বাগতম। আপনাদের ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক। বিশ্বের সবচেয়ে মালদার, সম্ভ্রান্ত ক্রিকেট দলকে আমাদের মাঝে পায়ে আমরা যারপরনাই আবেগে আপ্লুত। স্রস্টা আপনাদের সহায় হোন। এই বাংলাদেশী বেয়াদব, বখাটে ক্রিকেট গ্যাং এর হাত থেকে আপনাদের জানমাল, মানসম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলাম। আপনাদের আদর সমাদরের সব দায়িত্ব আমাদের। তবে ইজ্জতের নিশ্চয়তা দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। ইজ্জত মাঠে মারা গেলে অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন।


স্বাগতম, হে ভারতীয় ক্রিকেট দল
১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১
নক্সভিল, টেনেসি
বাংলাক্রিকেট-ডট-কম ফোরামে প্রথম প্রকাশিত