১৪ আগ, ২০১৪

"উচিত ছিল শেখ মুজিবের লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া”--- কর্নেল তাহের

ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া--- কর্নেল তাহের।

মহিউদ্দিন আহমেদের প্রকাশিতব্য বই জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি থেকে অংশবিশেষ প্রথম-আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। উপরের এই উক্তির প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে এভাবে:  ১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া

কর্নেল তাহেরের এই উক্তি পড়ে আমি তীব্রভাবে হতাশ হয়েছি। পড়া মাত্র প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসিকতা ধারণ করে বাংলার মাটিতে কেউ বীর হতে পারে না।

মহিউদ্দিন আহমেদের দেয়া তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের প্রশ্ন আছে। তবে তার বর্ণনা সামরিক ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের দেয়া জবানবন্দির সাথে অনেকাংশেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা সত্য যে কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পক্ষপাতী ছিলেন। সে কারণেই হয়তো তিনি ১৫ই আগস্টের পরপর তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। ফারুক-রশীদ-ডালিম-খন্দকার মোশতাকের খুনি চক্রের সাথে ১৫ই আগস্ট সকালেই তিনি রেডিও ভবনে বৈঠকে যোগ দেন। খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানেও কর্নেল তাহের উপস্থিত ছিলেন। এই খুনি চক্রের সাথে যোগাযোগের ফলশ্রুতিতেই হয়তো ১৫ আগস্টের পর খুনি মুজিব খুন হয়েছেঅত্যাচারীর পতন অনিবার্য শিরোনামে গণবাহিনীর পক্ষ থেকে লিফলেট প্রচার করা হয়।

কর্নেল তাহেরের আশা ছিল, খুনি চক্রকে দিয়ে দেশে সামরিক আইন জারি করে বাকশাল বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করানো।  মহিউদ্দিন আহমেদ তার বইয়ে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন১৫ই আগস্ট সকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত জাসদ গণ বাহিনীর এক সভায় আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ...র মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। 

বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের পক্ষে তার মনোভাব ও খুনিদের সাথে যোগাযোগের তথ্য কর্নেল তাহের নিজেই সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করে গেছেন। তার জবানবন্দি থেকেই সরাসরি উল্লেখ করছি: ১৬ই আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক শুধু আমার নামটাই ব্যবহার করছে, যাতে তাদের নেতৃত্বাধীন সিপাহীরা এই ধারণা পায় সে আমি তাদের সাথে রয়েছি। পরদিন ১৭ই আগস্ট এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে এর পেছনে খোন্দকার মোশতাকসহ আওয়ামী লীগের উপরের তলার একটা অংশও সরাসরি জড়িত। এই চক্র অনেক আগেই যে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল সেটাও আর গোপন রইল না। সেদিন থেকেই আমি বঙ্গভবনে যাওয়া বন্ধ করি ও এই চক্রের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করি।"

অর্থাৎবঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের নেপথ্য ভূমিকা এবং খোন্দকার মোশতাক পূর্ব-পরিকল্পনার বিষয় না থাকলে এবং সামরিক আইন জারি সহ বাকশাল বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনে রাজি হলে খুনি চক্রের সাথে কাজ করতে কর্নেল তাহেরের আপত্তি ছিল না। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে খুনের কোন ইচ্ছে তার ছিল নাকিন্তু খুন যখন হয়েই গেছে দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে খুনিদের সাথেই তিনি কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই অন্য বাড়তি ঝামেলা এড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার ব্যাপারে তার এই উক্তি খুব একটা অবাস্তব কিছু না।

কর্নেল তাহের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন সমর নায়ক হিসাবে তিনি যতটা সফল, রাজনীতিতে তিনি ততটাই ব্যর্থ ।  মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন ও সম্মুখ সমরের নিজের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসরের পর স্বাধীন দেশে  একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেশের ও জনগণের মঙ্গলের জন্য যে কোন ভূমিকা রাখতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজনীতিতে তার সব ভূমিকা দেশের মঙ্গলের চাইতে অমঙ্গলেরই কারণ হয়েছে। গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারকে টালমাটাল করে দেয়া ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে অনুকূল ভূমিকা রাখা, বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের সাথে যোগসূত্র স্থাপন, খুনিদের বিতাড়িত করে ক্ষমতার দখল নেয়া খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করা এবং পরিশেষে জিয়ার হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া......বাংলাদেশে আজকের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে উত্থান তার সবকিছুর পেছনেই কর্নেল তাহেরের ব্যর্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। কর্নেল তাহের সৎ নিয়তে একের পর এক ভুল মানুষের পক্ষ নিয়েছেন। 

জেনারেল জিয়া বিচারের নামে এক প্রহসনের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। আমার ধারণা কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক ভূমিকা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে জিয়ার হাতে তাহেরের হত্যা আমাদের বিবেচনা বোধকে প্রভাবিত করে। জেনারেল জিয়া ও বিএনপির রাজনীতির বিরুদ্ধে কর্নেল তাহের এখন একটি অস্ত্র। কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি পর্যালোচনার চেয়ে জিয়ার হাতে তাহেরের ফাঁসির ঘটনাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

আসুন, একটি কল্পকাহিনী সাজাই। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল। কর্নেল তাহের প্রাথমিক পর্যায়ে খুনিদের সাথে কিছুদিন কাজ করলেন। এরপর নভেম্বরে খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা নিয়ে নিলেন। ধরা যাক, জেল হত্যার ঘটনা ঘটলো না। ৭ই নভেম্বর জিয়ার পক্ষ নিয়ে কর্নেল তাহেরের সৈনিক বিপ্লব ঘটালেন। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হল। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় টিকে গেলেন। এবং কালক্রমে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়ক তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকার হল। আমার তো ধারণা, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ভূমিকা ও ৭ই নভেম্বরের সৈনিক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের কারণে তাজউদ্দীনের সেই কল্পিত সরকারই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিত। সে হিসাবে কর্নেল তাহেরের সৌভাগ্য যে তার হত্যাকাণ্ড জিয়ার হাতে ঘটেছিলো।  
    
বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষ অনেক অন্যায়-অবিচার ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য  কর্নেল তাহের যেমন তার কর্মকৌশল ঠিক করেছিলেন। সেই সময়েই তাজউদ্দীন, ভাসানী কিংবা মনি সিংহের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ছিলেন ও সেই প্রেক্ষাপটে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা থেকে তারা তাদের করনীয় নির্ধারণ করেছিলেন। এবং তাদের চিন্তা ভাবনার সাথে কর্নেল তাহেরের চিন্তা ও কর্মকৌশলের রয়েছে যোজন যোজন ফারাক।  আর তাই ১৯৭৫ এর প্রেক্ষাপটে আপনি যদি তাজউদ্দীন কিংবা মনি সিংহের বিচার-বিবেচনায় আস্থাশীল হন, তবে আপনি একই সাথে কর্নেল তাহেরের বিচার-বিবেচনায় আস্থাশীল হতে পারেন না। আর যাই হোক, তাজউদ্দীন কিংবা মনি সিংহের মত ব্যক্তিত্বেরা বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলা তো দুরের কথা, শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে খুনিদের সাথে কোন আলোচনায় বসতেন না।


৯ এপ্রি, ২০১৪

তাজিকিস্তানে রাধারমণ


বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত। জন্ম ১৮৩৩ সালে সিলেটেমৃত্যু ১৯১৫ সালে। এই সাধক কবি তিন হাজারেরও বেশী লোকগীতির স্রষ্টা। তার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের একটি ভ্রমর কইও গিয়া। রাধারমণের মৃত্যুর পর প্রায় ১০০ বছর পরে তাজিকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী Noziyai Karamatullo নিজের ভাষায় গাইছেন রাধারমণের "ভ্রমর কইও গিয়া গানের সুরে।

প্রখ্যাত তাজিক পপ গায়ক Karomatullo Qurbonov এর মেয়ে Noziyai Karamatullo। ১৯৯২ সালে তাজিক সিভিল ওয়ারের সময় তার ব্যান্ডের আরও কিছু সদস্য সহ Karomatullo Qurbonov কে হত্যা করা হয়।

রাধারমণের বিরহের সুর দেশ-কালের সীমানা মানে না।


৬ এপ্রি, ২০১৪

অনলাইন দেশপ্রেমিক


প্রবাসী অনলাইন দেশপ্রেমিকদের এখন খুব রমরমা অবস্থা। বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে ঘরে বসে বসে খুব সহজেই আমরা এখন কোন শালারে ছাড়া ছাড়ি নাই টাইপ কঠোর দেশপ্রেম দেখাতে পারি। দেশে থাকাকালীন সময়ে নিজের পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে সময় দেয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করি না। কিন্তু বিদেশে এসেই আমরা একেকজন ঝানু রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও সমাজসেবক হয়ে উঠি। দেশে যেমন সারা জীবন মালপানি কামিয়ে অবশেষে অনেকে রাজনীতিতে নামেন, আমরা প্রবাসী দেশপ্রেমিকেরাও বিদেশে নিজের নিরাপদ ক্যারিয়ার গড়ে রাজনীতিতে মন দেই। দেশের এই ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ আর আমাদের এই প্রবাসী দেশপ্রেমিকেরা মূলত একই শ্রেণী। মাটির সাথে, জনগণের নাড়ির সাথে বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই, অথচ  মারমুখী গরম গরম বক্তিমে ঝেড়ে রেম্বো মার্কা প্রতিরোধের ডাক দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা সবার আগে। আমরা প্রবাসী অনলাইন রেম্বো দেশপ্রেমিকেরা দেশের সকল লড়াই সংগ্রামে আপনার সাথে আছি, তবে   লাথি উশটা মেরে  কস্মিনকালেও কিন্তু আমাদের বিদেশ থেকে বের করা যাবে না!!

২০ মার্চ, ২০১৪

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলোয়াড় আমদানি

অনেকের হয়তো মনে আছে ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফির কথা। সেই টুর্নামেন্টে ভাড়া করার পাকিস্তানী খেলোয়াড় ব্যবহার করে আরব আমিরাত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে খেলার টিকেট যোগাড় করে নেয়। বাংলাদেশ ও কেনিয়ার প্রতিবাদের মুখে ১৯৯৬ সালে আইসিসি জন্মগত নাগরিক ছাড়া বাইরে থেকে খেলোয়াড় আমদানি করে জাতীয় দল গঠনের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে। ২০০৬ সাল থেকে এই কড়াকড়ি শিথিল করা হয়। যার বর্তমান চালচিত্র আমি নিচের একটি টেবিলে তুলে ধরেছি।



এবারের টি২০ বিশ্বকাপে প্রতিদলে আছে ১৫জন করে খেলোয়াড়। এই ১৫ জনের দলে আয়ারল্যান্ড, হংকং , নেদারল্যান্ড ও আরব আমিরাত দলে আছে ১০জনের বেশী আমদানি করা খেলোয়াড়!  হংকং দল যারা টুর্নামেন্টের ওয়ার্ম-আপ ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে, সেই দলে পাকিস্তানী খেলোয়াড় ৮ জন! আরব-আমিরাত দলে পাকিস্তানী ও ভারতীয় খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৯ জন! যে নেদারল্যান্ড দল জিম্বাবুয়েকে আজ প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলো তাদের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা খেলোয়াড় ১০ জন। ক্রিকেটের উন্নয়নের নামে এইভাবেই চলেছে এসোসিয়েট দেশগুলো আমদানি কর্মকাণ্ড।

টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য দাবী তুলছে যে আয়ারল্যান্ড দল, তারা তো যুক্তরাজ্যের  নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড থেকে খেলোয়াড় দিয়ে দল ভারী করছে। ইংল্যান্ড দল ও আয়ারল্যান্ড দল দুই দেশই  নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের খেলোয়াড় ব্যবহার করতে পারছে। আয়ারল্যান্ড দলে যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১০ জন। আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের দলের মধ্যে এই খেলোয়াড় চালাচালি জায়েজ করতেই আইসিসির প্লেয়ার ইলিজিবিলিটি রুলস এর নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন ধরা যাক, আয়ারল্যান্ডের এড জয়েস ১৯৯৯-২০০৬ সালে খেলেছেন আয়ারল্যান্ডের হয়ে। এরপর ২০০৭-২০১০ খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। এরপর ২০১১ থেকে তিনি আবার আয়ারল্যান্ড দলে। স্বয়ং ইংল্যান্ড দলেই বিদেশী খেলোয়াড়ের সংখ্যা দলের এক-তৃতীয়াংশ।

এসোসিয়েট দেশগুলোর পারফর্মেন্স উন্নতির জন্য এভাবে খেলোয়াড় আমদানি নীতি চালু রেখে জাতীয় দলকে পরিণত করা হচ্ছে ক্লাবে। ফলে নেপাল ও আফগানিস্তানের মতো খাঁটি জাতীয় দলকে পড়তে হচ্ছে চাপের মুখে। এক সময়ের সারা জাগানো কেনিয়া দল তো এবার তাদের ওডিআই স্ট্যাটাস হারিয়ে ফেলেছে আমদানি নির্ভর আমিরাত দলের কাছে।

জাতীয় দল হোক দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল দল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হোক জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসর।

১৮ মার্চ, ২০১৪

নেপাল ক্রিকেট দল

কাঠমুন্ডুতে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাথে নেপাল দলের খেলা দেখছে নেপালের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শক। ১৮ই মার্চ ২০১৪।

এই হল ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসা!
নেপাল ক্রিকেট দলের জন্য শুভকামনা।
এটি সত্যিকার অর্থেই একটি জাতীয় দল।
নেপাল দলের ১৫জন খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই জন্মগত-ভাবে নেপালি। 
হংকং, আমিরাত, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডের মতো বিদেশী খেলোয়াড় দিয়ে গড়া দল নয়।
এই চার দলের ১৫ x ৪= ৬০ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৪১জনই বিদেশী!!   
শতভাগ নেপালি খেলোয়াড় দিয়ে গড়া নেপালের জনগণের প্রতিনিধিত্ব-শীল এই নেপাল ক্রিকেট দলের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণের সুযোগ আরও অবারিত হোক।


১০ মার্চ, ২০১৪

আটকেপড়া পাকিস্তানী বনাম আটকেপড়া বাংলাদেশী

আটকেপড়া পাকিস্তানীঃ স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের শেষে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পাকিস্তানে ফিরতে না পেরে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করে অতঃপর একসময় বাংলাদেশের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আবেদন জানাতে থাকা উর্দু ভাষাভাষী পাকিস্তানী বিহারী জনগোষ্ঠী

আটকেপড়া বাংলাদেশীঃ উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকায় এসে শিক্ষাজীবন শেষে নানা অর্থনৈতিক ও টেকনিক্যাল টানাপোড়েনে বাংলাদেশে ফিরতে না পেরে (বা ফিরতে না চেয়ে) দীর্ঘদিন আমেরিকায় অবস্থান করে অতঃপর একসময় আমেরিকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আবেদন জানাতে থাকা বাংলা ভাষাভাষী বাংলাদেশী ছাত্র-জনগোষ্ঠী।


আটকেপড়া পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের মঙ্গল কামনায় পাকিস্তানবাসীদের উদ্দেশ্যে নানাবিধ উপদেশমূলক ব্লগ রচনা করে কিনা সেটা একবার খোঁজ নেয়া দরকার।   

৩ ফেব, ২০১৪

নীরব বিপ্লব

কি আনন্দ! কি আনন্দ!
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের স্কুল পর্যায়ের বই পড়া কর্মসূচীতে বই পড়ে পুরস্কার হিসাবে আরও বই পেয়েছে এই মাঠ ভর্তি হাজার হাজার শিশু।


প্রতিটি বই পড়ে শেষ করার পর আজও আমি একটু একটু করে বদলে যাই। নতুন করে ভাবি, শাণিত হই।  আমি নিশ্চিত এই শিশুরাও এভাবে একটি একটি করে বই পড়ে ভাবতে শেখে, চিন্তায় শাণিত হয়ে ওঠে। গত ২৫ বৎসর ধরেই এভাবে চলছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এই বই পড়া কর্মসূচী।  প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ শিশু-কিশোর এভাবে বই পড়ছে। দেড় লক্ষ চিন্তাশীল মানুষ তৈরি হচ্ছে। কি বিশাল কর্মযজ্ঞ! নীরবে চলছে কি দারুণ এক বিপ্লব!  

ছবিঃ প্রথম-আলো

২ ফেব, ২০১৪

মনে মনে মুসলমান

 

বন্ধুবর সাকিব হাসান জীবনানন্দের কবিতার সাথে সাথে একই ভাবধারায় বর্ণিত সুরা বনি ইসরায়েলের একটি আয়াত জুড়ে দিয়ে লিখেছেঃ

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
-জীবনানন্দ দাশ

"হে মানবজাতি তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া" - সুরা বনি ইসরাইল

সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের ছোটবেলার ঘটনা। ১৯০৫-০৬ দিকে তিনি তখন ময়মনসিংহের দরিরামপুর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। তখন ব্রিটিশ আমল। তার শিশুমনে যেমন আছে ইংরেজ বিদ্বেষ, তেমনি আছে সমাজে হিন্দু-আধিপত্যের বিপরীতে মুসলমান হিসাবে নিজের টনটনে আত্ম-পরিচয়। সেই সময় ঢাকা বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর মিঃ স্টেপলটন স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। এই ইংরেজ সাহেবের আগমন উপলক্ষে চারিদিকে সাজ সাজ রব। সাহেব আসার পর দেখে গেল তার সাথী পাগড়ি-আচকান-পায়জামা পরিহিত শুশ্রুমন্ডিত একজন আলেম। বালক আবুল মনসুর ভাবলেন, যেহেতু এই ইংরেজ সাহেব একজন আলেম সাথে নিয়া চলাফেরা করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে মুসলমান। ভক্তিতে গদগদ হয়ে তার ইংরেজ-বিদ্বেষ দূর হয়ে গেলো। অবশ্য যখন জানলেন পারলেন সাহেবের সঙ্গী লোকটি আলেম নন, বরং পাগড়ি-আচকান পরিহিত ইংরেজের একজন চাপরাশি মাত্র তখন তার এই ইংরেজ-বিদ্বেষ ফিরে আসতে মোটেও বেশী সময় লাগেনি।

জীবনানন্দের কবিতার সাথে সুরা বনি ইসরায়েলের আয়াতের সাদৃশ্য দেখে আবুল মনসুর আহমেদের সেই গল্পের কথা মনে পড়লো। ভাবছি, জীবনানন্দ নিশ্চয়ই ছিলেন “মনে মনে মুসলমান” !!!

৩০ জানু, ২০১৪

পেছনে কাহিনী আছে!!

শ্রীলঙ্কার সাথে প্রথম টেস্টে অমনোযোগী হয়ে মারমুখী শট খেলতে গিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয় ডেকে এনেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা। তবে এর পেছনে কাহিনী আছে!!

২৭শে জানুয়ারি সকালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ দল যখন মাঠে নামছে তখনও বাংলাদেশের মাথার উপর ঝুলছে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বিগ-থ্রি জোটের জারি করা টেস্ট ক্রিকেট থেকে রেলিগেশনের হুমকি। মাঠে নামার পর দেখা গেল খেলার দুই আম্পায়ার হলেন ইংল্যান্ডের নাইজেল লং এবং অস্ট্রেলিয়ার পল রাইফেল। এর সাথে ম্যাচ রেফারী হিসাবে আছেন ইন্ডিয়ার জাগাভাল শ্রীনাথ। এখানেও সেই ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বিগ-থ্রি জোট। একে তো মাথার উপরে বিগ-থ্রির হুমকি আর মাঠে চোখের সামনে এরকম বিগ-থ্রির প্রতিমা...এ অবস্থায় বাংলাদেশ দল খেলায় মনোযোগ হারিয়ে মারমুখী হয়ে উঠবে না তো কি করবে! 

২৯ জানু, ২০১৪

অমানবিক ৭০০ রান

অবশেষে ৬ উইকেটে ৭৩০ রান তুলে ডিক্লেয়ার করলো শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের ১৪ বছরের টেস্ট ইতিহাসে এতো বড় রানের বোঝা কেউ আগে বাংলাদেশের উপর চাপাতে পারেনি। ২০১২ সালের নভেম্বরের খুলনাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৯ উইকেটে ৬৪৮ রান ছিল এতদিন বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

এরকম সেভেন হান্ড্রেড প্লাস রানের ইনিংস খেলার “বিকৃত মানসিকতা” অবশ্য শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন না। ১৩৭ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৭০০ বা তার বেশী রানের ইনিংস খেলার কাণ্ড ঘটেছে মাত্র ২১বার। তার মাঝে সবে ১৯৮২ সালে টেস্ট খেলা শুরু করে একা শ্রীলঙ্কাই এই অমানবিক কাণ্ড ঘটিয়েছে সর্বোচ্চ ৫বার।

২৭ জানু, ২০১৪

আইসিসি সংস্কার প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের নিজস্ব লড়াই

আইসিসি সংস্কার প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের নিজস্ব লড়াই

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আইসিসি সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে না বিপক্ষে অবস্থান নিবে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের সংবাদ মিডিয়াতে এসেছে। একবার জানা গেলো, বিসিবি ২০-৩ ভোটে প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে বিসিবি আবার জানিয়ে দিলো প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কোন সিদ্ধান্ত বিসিবির সভাতে হয়নি।  সর্বশেষ অবস্থান হল, বিসিবি বাকি ক্রিকেট বোর্ডগুলোর অবস্থান জানার পর এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে।   ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড যৌথভাবে আইসিসির কার্যক্রম সংস্কারের লক্ষ্যে যে প্রস্তাব এনেছে তার সাথে সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেরই লাভ ক্ষতি জড়িত। তাই সকলের সাথে মিলিয়ে বিসিবির সিদ্ধান্ত নেয়ার মনোভাব হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু এই প্রস্তাবের সাথে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে যাবার ব্যাপারটাও জড়িত। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংগ্রাম একার। এই একাকী সংগ্রামে দেখি না কি হয় নীতির পরিবর্তে প্রয়োজন সক্রিয় ক্রিকেট ও রাজনৈতিক কূটনীতির উদ্যোগ।

আইসিসি প্রস্তাবের প্রধান অংশগুলো হল (কোন নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে নয়)
(১) আইসিসির আয়-রোজগারের ভাগবন্টন
(২) বিভিন্ন দেশের মধ্যকার ক্রিকেট ট্যুর প্রোগ্রাম নির্ধারণের ক্ষমতা আইসিসি হাত থেকে তুলে নেয়া
(৩) আইসিসির পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দেয়া।
(৪) টেস্ট ক্রিকেটকে প্রমোশন-রেলিগেশনের ব্যবস্থাসহ দুই-স্তর বিশিষ্ট পদ্ধতিতে আনা (ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া রেলিগেশনের বিধান থেকে মুক্ত)

আসুন একে একে উপরের বিষয়গুলো বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

আইসিসির আয়-রোজগারের ভাগবন্টনঃ

ক্রিকেট খেলা থেকে আয়োজকদের (আইসিসি কিংবা ক্রিকেট বোর্ড) প্রধান আয়ের উৎসগুলো হল খেলার সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রিখেলার অফিসিয়াল সরঞ্জামের স্পন্সরশীপ বিক্রি, সিরিজ বা টুর্নামেন্টের স্পন্সরশীপ বিক্রি এবং খেলার টিকেট বিক্রি।

কার কার মধ্যে খেলা হচ্ছে তার ভিত্তিতে খেলা আয়োজনের আয় নির্ভর করে। যেমন, বাংলাদেশ যদি জিম্বাবুয়ের সাথে খেলে, সেই খেলার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েতে মূলত: দর্শকদের আগ্রহ থাকবে। এখন খেলাটা যদি বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার মধ্যে হয়, তাহলে বাংলাদেশের দর্শকের সাথে যোগ হবে ইন্ডিয়ার বিশাল দর্শকের মার্কেট। এছাড়া এই দুই দেশ বাদেও অন্যত্রও এই খেলা নিয়ে  কিছুটা আগ্রহ তৈরি হবে। এখন খেলাটা যদি ইন্ডিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হয় কিংবা ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হয়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশছাড়াও সেই খেলার জন্য ক্রিকেট-প্রেমী দর্শকদের একটা গ্লোবাল মার্কেট থাকে। এভাবে একটা খেলার দর্শকের মার্কেট যত বড়, সেই খেলা সম্প্রচার-স্বত্বের দামও তত বেশী।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক, সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজের সম্প্রচার-স্বত্ব বিক্রি হয়েছিলো ৮৭ লক্ষ টাকায়। আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সিরিজের সম্প্রচার-স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ১ লক্ষ টাকায়। এখন বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে সিরিজ হলে তার সম্প্রচার-স্বত্ব থেকে আয়ও অনেক কমে যাবে। সম্প্রচার-স্বত্বের মতো একই ভাবে  খেলার অন্যান্য স্পন্সরশীপ বিক্রি থেকে আয় খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা-কারী দলের ভিত্তিতে উঠানামা করে। মনে পড়ে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের এক সিরিজের স্পন্সরশীপ জোগাড় করতে খেলা শুরুর আগের দিন পর্যন্ত বিসিবিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। এখন বাংলাদেশ যদি ইন্ডিয়ার সাথে খেলে, শোনা যায়, সেই খেলার সম্প্রচার-স্বত্ব বিক্রি করে এতো আয় হয় যে বিসিবিকে কয়েক বছর আর টাকা নিয়ে ভাবতে হয় না!! ক্রিক-ইনফোতে প্রকাশিত এক  রিপোর্টে বলা হয় ইন্ডিয়া খেললে খেলার ফরম্যাট-ভেদে (টেস্ট, ওয়ানডে বা টি-২০) ম্যাচ প্রতি স্বাগতিক দেশের আয় হয় প্রায় ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন আসবে ইন্ডিয়ার খেললে আয় বেশী হয় কেন। ইন্ডিয়ার এক বিশাল দর্শক ভিত্তি আছে। মাঠের দর্শক তো আছেই, সেই সাথে আছে বিশাল টিভি দর্শক। ইন্ডিয়ার এই বিরাট দর্শক সংখ্যার মধ্যে রয়েছে বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই খেলা সম্প্রচারের সময় এতো বিশাল মার্কেটে বিজ্ঞাপন দেয়ার মতো আছে অনেক ইন্ডিয়ান কোম্পানি। এই দর্শকদের ক্রয় ক্ষমতা এবং সেই দর্শকদের কাছে পণ্য বা সেবা বিক্রিতে আগ্রহী কোম্পানীর সংখ্যা এসব মিলিয়ে ইন্ডিয়ার খেলা মানেই এক এলাহি কারবার।

বাংলাদেশেরও তো দর্শক আছে। তাহলে বেশী আয়ের আশায় আমাদের সাথে খেলার জন্য সবার আগ্রহী হবার কথা। কিন্তু তার বদলে আমাদের টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে কেনআমাদের দেশে ক্রিকেট অনুরাগী অনেক। কিন্তু খেলার মাঠে ও টিভির সামনে বসতে পারা দর্শকের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। এছাড়া এই দর্শকদের ক্রয়-ক্ষমতার প্রশ্ন আছে। এই দর্শক মার্কেটে পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে আগ্রহী প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে ছোট।  এছাড়া আমাদের ক্রিকেটের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে যদি এখন স্কটল্যান্ড খেলতে আসে, বাংলাদেশের কতজন দর্শকের তাতে আগ্রহ থাকবে? তেমনি বাংলাদেশের সাথে অন্য শক্তিশালী দেশের খেলা নিয়ে সেই দেশের দর্শকদের আগ্রহ কম বেশী হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে খেললে সেই খেলার  সম্প্রচার-স্বত্বের মূল্য তেমন বেশী হয় না।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই, ক্রিকেটের বাণিজ্যে ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের রয়েছে বিশাল প্রভাব। ইন্ডিয়ার সাথে খেললে সেই খেলা সম্প্রচারের স্বত্ব অনেক বেশী দামে বিক্রি হয়। কারণ ইন্ডিয়াতে সেই খেলা সম্প্রচার করে ইন্ডিয়ান কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ বিশাল আয়-উপার্জন করা যায়।

আইসিসির টাকা আসে আইসিসি ইভেন্ট থেকে। সব ক্রিকেট আইসিসি ইভেন্ট নয়। ক্রিকেট বিশ্বকাপ, টি-২০ ওয়ার্ল্ড কাপ, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, প্রমীলা বিশ্বকাপ, এসোসিয়েট দেশগুলো নিয়ে  সাবেক আইসিসি ট্রফির ধরণের নানা টুর্নামেন্ট প্রভৃতি হল আইসিসি ইভেন্ট।  কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ হচ্ছে সেটা আইসিসি ইভেন্ট নয়। এই খেলা থেকে আয়ের ভাগ পাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। তবে আয়োজক দেশ হিসাবে সিংহভাগ পাবে স্বাগতিক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসি ইভেন্ট হলে সেই খেলার সিংহভাগ জমা হয় আইসিসির তহবিলে।  

আইসিসি ইভেন্টে সব দেশের অংশগ্রহণ থাকে বলে তা থেকে আয়ও অনেক বেশী। যেমন ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলারে (প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা)। এর পুরোটাই মুনাফা নয়। অনুষ্ঠান আয়োজনের খরচ, আয়োজক দেশের জন্য বরাদ্দ, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর জন্য বরাদ্দ এবং আইসিসির নিজস্ব প্রশাসনিক খরচ বাদ দেয়ার পর যা মুনাফা হয় সেটাই আইসিসির তহবিলে জমা হয়। এভাবে ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে আইসিসির নীট মুনাফা হয়েছিলো প্রায় ৩২২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা)। এভাবে বর্তমান বাণিজ্যিক সাইকেলে আইসিসির আয় প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।

এখন প্রশ্ন হল, আইসিসি এই টাকা দিয়ে কি করে? আইসিসি মুনাফার অংশের ৭৫ ভাগ দশটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ তথা পূর্ণ সদস্য দেশের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়। অর্থাৎ আইসিসি মুনাফার সাড়ে সাত শতাংশ পায় বাংলাদেশ। বাকি সব দেশও এভাবে সমান ভাবে সাড়ে সাত শতাংশ করে পায়। টেস্ট খেলুড়ে দেশ গুলোকে এভাবে বরাদ্দ দেয়ার পর বাকি ২৫% আইসিসি ব্যয় করে সহযোগী সদস্য দেশের ক্রিকেট উন্নয়ন খাতে। যেমন চীন, মালয়েশিয়া, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের ক্রিকেটে আই আইসিসি বরাদ্দ দেয়।

ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড তাদের প্রস্তাবে বলেছে সবার মধ্যে এভাবে সমানভাবে টাকা ভাগ করে দেয়া চলবে না। কারণ আইসিসি যে আয় করে, তার পিছনে সবার ভূমিকা সমান নয়। তারা বলেছে, ইন্ডিয়া যদি আইসিসি ইভেন্টে না খেলা তাহলে আইসিসির আয় প্রায় ৮০ ভাগ কমে যাবে। (বি: দ্রঃ ইন্ডিয়া ছাড়া আইসিসি ইভেন্ট হলে আইসিসির আয় ৮০ ভাগ কমে যাবে এই দাবীর পিছনে কোন সাপোর্টিং ডকুমেন্ট অবশ্য দেয়া হয়নি। প্রায় ছয় বছর আইসিসির অর্থ বিভাগের নেতৃত্ব দেয়া ও আইসিসির সাবেক প্রেসিডেন্ট এহসান মানির মতে ইন্ডিয়া না খেললে আইসিসি ইভেন্ট থেকে আয় অনেক কমে যাবে, তবে তা কিছুতেই ৮০ ভাগ হ্রাস পাবে না।)। যাই হোক, তাদের মতে আইসিসির আয়ের পিছনে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া এই তিন দেশের অবদান সবচেয়ে বেশী। তাই ভবিষ্যৎ আইসিসির আয় যা বাড়বে, সেই বাড়তি অংশে তিন দেশকে সবচেয়ে বেশী অংশ দিতে হবে। যেমন, আইসিসির বর্তমান আয় দেড় বিলিয়ন ডলার। এটা যদি বেড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হয়, তাহলে এই বাড়তি ২ বিলিয়ন ডলারের ৫৪ শতাংশ দিতে হবে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, সব দেশ সমান ভাবে আইসিসির বরাদ্দের উপর নির্ভরশীল নয়। বিশেষ করে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া মোটেই আইসিসির আয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটের স্বত্ব বিক্রি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক পার্টনারদের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে ইংল্যান্ড ২০১২ সালে আয় করেছে ২৮০ মিলিয়ন পাউন্ড। এই সময় কালে একই খাত থেকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের আয় ছিল ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ইন্ডিয়ার আর এর চেয়েও অনেক বেশী। কারণ তার রয়েছে আইপিএল। মোটামুটি ভাবে দেখা যায়, এই তিন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের আয়ের ২০% বা তার কম আসে আইসিসি থেকে। কিন্তু বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে আইসিসির বরাদ্দ তাদের আয়ের অন্যতম প্রধান অংশ। 

এভাবে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড  আইসিসির মুনাফা থেকে বেশী টাকা নিয়ে নিলে অন্যদের ভাগে কম পড়বে। তাদের এই আয় কমে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর ২৫% বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দিতে হবে। সেই গরীবের টাকা নিয়ে এসে একটি টেস্ট ম্যাচ ফান্ড তৈরি করার হবে। এই টেস্ট ম্যাচ ফান্ডের টাকা পাবে দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে বাকি পূর্ণ সদস্য সব দেশ। তার মানে ভবিষ্যতে টেস্ট খেলার অধিকার না থাকলেও বাংলাদেশ এই টেস্ট ম্যাচ ফান্ডের ভাগ পাবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা পাবে না।  

দক্ষিণ আফ্রিকার কে তারা টাকা দিতে চায় না কারণ ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডকে একটা শিক্ষা দিতে চায়। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বোর্ডের সিইও বানিয়েছে সাবেক আইসিসি সিইও হারুন লোরগাটকে। ইন্ডিয়ার এটি পছন্দ হয়নি। ইন্ডিয়া চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সিইও কাকে করবে সে ব্যাপারে ইন্ডিয়ার পরামর্শ শুনুক। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা সেই কথা না শুনে নাই। এতে ইন্ডিয়া ভীষণ নাখোশ।  এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ইন্ডিয়া তাদের সফর বাতিল করে দিতে চেয়েছিল। শেষে ইন্ডিয়া বিষয়ক কোন কাজে দক্ষিণ আফ্রিকা হারুন লোরগাটকে আনবে না এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ইন্ডিয়া দুটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে খেলতে যেতে রাজি হয়। মূল প্ল্যানে ছিল ইন্ডিয়া সেখানে তিনটি টেস্ট, সাতটি ওয়ান ডে ও দুটি টি-টুয়েন্টি খেলবে। হারুন লোরগাটকে সিইও বানানোর জরিমানা হিসাবে ইন্ডিয়া  সফর থেকে একটি টেস্ট, চারটি ওয়ান ডে ও  দুটি টি টুয়েন্টি কেটে দেয়। আগেই বলা  হয়েছে, ইন্ডিয়ার সাথে খেলা মানেই বিশাল আয়। সেই হিসাবে, সফরে ম্যাচ কমিয়ে দেয়া মানেই হল স্বাগতিক দেশের জন্য বিশাল আর্থিক ক্ষতি।

হারুন লোরগাট এর পিছনে ইন্ডিয়া ক্রিকেট বোর্ডের এভাবে লাগার কারণ তাদের দৃষ্টিতে হারুন লোরগাট নানা অপরাধে অভিযুক্ত
(১) হারুন লোরগাট আইসিসি সিইও থাকার সময় খেলায় ক্যামেরার মাধ্যমে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত রিভিউ করার  ডিআরএস পদ্ধতি সব খেলায় চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাকি সব দেশ খেলায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারে রাজি থাকলেও ইন্ডিয়া মোটেই রাজি নয়। হারুন লোরগাটের চাপে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডিআরএস পদ্ধতি সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
(২) হারুন লোরগাট আইসিসির প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের জন্য উলফ কমিশন গঠন করেছিলেন। এই উলফ কমিশনের অন্যতম একটা সুপারিশ ছিল, আইসিসিকে শক্তিশালী দেশগুলোর প্রভাবমুক্ত করার জন্য স্বাধীন আইসিসিতে ডিরেক্টর ও নিরপেক্ষ ডিরেক্টর নিয়োগ এবং আইসিসির টাকা সমান ভাগে ভাগ না করে যে দেশের যেমন দরকার সেই দেশকে তার প্রয়োজনের ভিত্তিতে টাকা দেয়া। লক্ষণীয় যে, এই দুটি পরামর্শই ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া প্রস্তাবে ১০০% উলটে দেয়া হয়েছে। বড় দেশের প্রভাবমুক্ত করার পরিবর্তে আইসিসিকে এই তিন দেশের নিয়ন্ত্রণে আনার এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে  টাকা দেয়ার বদলে এই তিন দেশকে বেশী টাকা দেয়ার প্রস্তাব আনা হয়েছে।
(৩) কোন দেশ কার সাথে কখন কোথায় কতবার খেলবে তার একটা সূচী আই আইসিসি তাদের ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রামে (এফ টিপি) ঠিক করে দেয়। ইন্ডিয়া বরাবরই এই এফটিপির লঙ্ঘন করে এসেছে। যেমন গত ১৩ বছরে বাংলাদেশকে একবারের জন্যও তারা ইন্ডিয়া সফরে ডাকে নাই। অথচ এফটিপি অনুযায়ী এই সময়ে অন্তত দুইবার বাংলাদেশের ইন্ডিয়া সফর করার কথা ছিল। এভাবে এফটিপি লঙ্ঘনের দায়ে হারুন লোরগাট ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব তুলেছিলেন। ইন্ডিয়া এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হারুন লোরগাটের বিরুদ্ধে নৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আইসিসির মাধ্যমে তদন্তের দাবী তুলেছে।

সব মিলিয়ে হারুন লোরগাট আইসিসি সিইও থাকা কালে ইন্ডিয়ার সাথে বেশ কিছু বিষয়ে ক্যাচাল বাধিয়েছিলেন। তাই এমন কোন লোককে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বোর্ডের সিইও করুক সেটা ইন্ডিয়া চায় নাই। এই গেলো দক্ষিণ আফ্রিকার উপর ইন্ডিয়ার নাখোশ হবার কারণ। তার পরিণতিতেই আইসিসির ফান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একতরফা-ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এটা ঠিক যে এই তিন দেশের ক্রিকেটের অর্থনৈতিক ভিত্তি অন্যদের তুলনায় শক্তিশালী এবং তাদের অংশগ্রহণের কারণে আইসিসি ইভেন্টের আয়-রোজগার ভালো হয়। তাই সেই আয়-রোজগারের বেশী অংশ তারা দাবী করতেই পারে। আবার বিপক্ষে বলা যায়, ইন্ডিয়ার সকল দর্শক যে শুধু ইন্ডিয়ার জন্য ক্রিকেট দেখে তা নয়। ইন্ডিয়া ছাড়া বিশ্বকাপ হলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে ইন্ডিয়াতে বিশ্বকাপের দর্শক থাকত। তাই আইসিসি ইভেন্টের জন্য নিজ নিজ দেশের দর্শকদের আগ্রহের একমাত্র দাবীদার কেবল এই তিন দেশ নয়। ফুলের প্রতি মানুষের যেমন ভালোবাসা থাকে, অনেক ফুলের সমন্বয়ে মালা গাথা হলে সেই মালারও আলাদা একটা মূল্য থাকে। বিশ্বকাপে ইন্ডিয়া আছে বলে বিশ্বকাপের দর্শক যেমন বাড়ে, তেমনি খেলাটা সকল দলের অংশগ্রহণে বিশ্বকাপ বলে সেই খেলায় ইন্ডিয়ার অংশগ্রহণের মূল্য আলাদাভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই সবই একাডেমিক আলোচনা। বাস্তবতা হল, ইন্ডিয়ার সাথে খেলে আর্থিক-লাভ অনেক বেশী। সেটাকে পুঁজি করে ইন্ডিয়া ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে বিসিসিআই আইসিসির মুনাফার বাড়তি অংশ দাবী করছে।

ক্রিকেট ট্যুর প্রোগ্রাম নির্ধারণ:

বর্তমানে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো একে অন্যের দেশে কখন কিংবা কতবার সফর করবে তা আইসিসি ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম (এফটিপি) এর মাধ্যমে ঠিক করে দেয়। আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলো একে অন্যের সাথে যাতে নিয়মিত খেলতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য টেস্ট দলগুলো প্রতি ১০ বছর মেয়াদে কখন কোথায় সফরে যাবে তা এই এফটিপিতে বলে দেয়া থাকে।  এই এফটিপি মেনে চলা সদস্য-দেশ গুলোর দায়িত্ব।

আইসিসির ১০-বছর মেয়াদী ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম (এফটিপি)  এর আওতায় প্রতি ১০-বছর মেয়াদী এফটিপি সাইকেলে  টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে অন্তত: একবার করে একে অন্যের দেশে খেলতে যাবার কথা। ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সালের প্রথম ১০-বছর মেয়াদী এফটিপি শেষ। এখন চলছে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের দ্বিতীয় ১০-বছর মেয়াদী এফটিপি, যার ৩ বছর ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে।

ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বিরুদ্ধে এফটিপি লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। যেমন, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া জিম্বাবুয়ের সাথে খেলেনি। এছাড়া আইসিসির এই এফটিপি বা ট্যুর প্রোগ্রামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের ১৩ বছরে একবারও বাংলাদেশকে ভারতে খেলতে ডাকেনি। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া প্রথম এফটিপি মেনে বাংলাদেশকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং বাংলাদেশে সফরে এসেছে। কিন্তু দ্বিতীয় এফটিপিতে ভারতের অনুসরণে তারা বাংলাদেশের সাথে খেলা বন্ধ করে দিয়েছে।

এফটিপি মেনে চলতে সমস্যা কোথায়? এফটিপিতে সবার সাথে সবার সিরিজ খেলার নিয়ম। কিন্তু সব সিরিজে সমান লাভ হয় না। কোন কোন সিরিজ থেকে স্বাগতিক দেশের আর্থিক ক্ষতি হবার কথাও শোনা যায়। যেমন এই বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে শ্রীলঙ্কার সফর থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি হবার প্রজেকশন ছিল। তারা তাই শ্রীলঙ্কার টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজের বদলে শ্রীলঙ্কা ও ইন্ডিয়াকে নিয়ে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ আয়োজন করে বিশাল আর্থিক লাভ করেছে। এছাড়া ইন্ডিয়ার মতে বাংলাদেশকে খেলতে ডাকলে তাদের বেশী লাভ হয় না। এর বদলে ইন্ডিয়া বরাবরই বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাব করে। এযাবৎ ইন্ডিয়া পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছে। বাংলাদেশও এর আপত্তি করে না। কারণ ইন্ডিয়াকে দেশে হোস্ট করতে পারলে লাভের শেষ নাই!  কোন সিরিজে লাভ হবে, কোন সিরিজে ক্ষতি হবে। মোটের উপর পুষিয়ে যাবার কথা। কিন্তু যদি এফটিপির অলাভজনক খেলাগুলো না যদি খেলি, তাহলেই তো ক্ষতি পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব...এরকম চিন্তা থেকে এফটিপি লঙ্ঘনের সূত্রপাত ঘটে।     

এফটিপি নিয়ে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যার সূত্রপাত ইন্ডিয়ার ঘরোয়া টি-২০ টুর্নামেন্ট আইপিএল শুরুর পর থেকে। যেহেতু এটা ইন্ডিয়ার ঘরোয়া টুর্নামেন্ট, তাই এই টুর্নামেন্টের জন্য এফটিপিতে কোন জায়গা বরাদ্দ করতে আইসিসি রাজি নয়। কিন্তু সেই সময় যদি অন্য দেশের খেলা চলতে থাকে তাহলে সেইসব দেশের অনেক নামী খেলোয়াড়েরা আইপিএল-এ আসতে পারে না। এতে আইপিএল এর দলগুলোর যেমন সমস্যা হয়, তেমনি টুর্নামেন্টের আকর্ষণের কমতি পড়ে। ইন্ডিয়া বারবার আইসিসির উপর চাপ দিয়েছে আইপিএল এর জন্য এফটিপিতে সময় রাখা হোক। তা যেহেতু আইসিসি দেয়নি, তাই এই এফটিপি প্রোগ্রাম বাতিল করে দেয়া ইন্ডিয়ার জন্য কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবে বলে হয়েছে এফটিপি বাতিল হয়ে যাবে এবং তার পরিবর্তে টেস্ট দলগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করবে। এর ফলে তাদের কোন অলাভজনক খেলা খেলতে হবে না এবং আইপিএল এর মতো টুর্নামেন্ট এর জন্য সময় বের করা যাবে।

এফটিপির বদলে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিভিত্তিক সফরে সমস্যা কোথায়? সবাই এফটিপি মেনে না চললেও এফটিপির কারণে বাংলাদেশে অনেক দলকে খেলতে আসতে হয়। এফটিপি বাতিল হলে তখন বাংলাদেশেকে খেলা পাবার জন্য অন্যদলের সাথে দেন-দরবার করতে হবে। বাংলাদেশে সফরে আসলে গত কয়েক বছরে নিউজিল্যান্ডের নাকুনি চুবানি অবস্থা হচ্ছে। এফটিপি না থাকলে চিন্তা করে দেখুন তাদের বাংলাদেশে আবার তাদের আনতে আমাদের মত কাঠখড় পোড়াতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে, সাধারণভাবে আমাদের খেলার মান অন্যদের মতো ধারাবাহিক ভাবে ভালো নয় বলে একটা রেপুটেশনের সমস্যা রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশকে সফরে ডাকা অনেকের জন্যই লাভজনক হয়না।  এফটিপি সকলে মানে না। তবে এফটিপি না থাকলে এখন যেসব ম্যাচ পাওয়া যায় সেটিও আর পাওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে দাড়াতে পারে।

প্রস্তাব অনুসারে ২০১৫ সাল থেকে আগামী ৫ বছর বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের আর টেস্ট খেলার সম্ভাবনা নেই। এখন বাংলাদেশ যদি আদৌ আর টেস্ট না খেলে সেক্ষেত্রে এফটিপি থাকা বা না থাকার এই ব্যাপার  অনেকটাই অবান্তর হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে হয়তো দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে ওয়ানডে সিরিজ আয়োজনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

তবে এটি শুধু বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের সমস্যা না। এফটিপি না থাকলে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডকেও বিগ থ্রি ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সাথে ম্যাচ পেতে কষ্ট করতে হতে পারে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া অবশ্য নিশ্চয়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে বাদে (বিঃদ্রঃ এই দুটো দলকে প্রস্তাব অনুসারে আপাতত আর টেস্ট খেলতে দেয়া হবে না) বাকি দলগুলোর সাথে প্রথম মেয়াদে তারা দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করবে। ইন্ডিয়া অবশ্য এই রকমের কোন নিশ্চয়তা দেয় নি।  খেলা বা খেলার মান মুখ্য বিষয় নয়, খেলার আর্থিক বিবেচনাই তখন ম্যাচ শিডিউল নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব রাখতে পারে।

আইসিসি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দেয়া:

একটা সময় ছিল ক্রিকেট বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হতো ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গুলি হেলনে। ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপের পর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে ইন্ডিয়ার অর্থনৈতিক দাপট পরিস্ফুট হতে থাকে। ফলে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার একচেটিয়া আধিপত্যের দিন অবসান হয়ে তা ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ার হস্তগত হয়। ইন্ডিয়ার এই একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় যা কিছু বাদ প্রতিবাদ হয়েছে, তা এসেছে   ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে। ফলে আমেরিকান ব্লক ও রাশিয়ান ব্লকের ভেতরে যেমন প্রায় অর্ধ শতাব্দী জুড়ে বিশ্বে কোল্ড-ওয়ার চলেছে, ক্রিকেট দুনিয়াতেও তেমনি চলে এসেছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বনাম ইন্ডিয়া-এশিয়ান ব্লকের ক্রিকেটীয় কোল্ড-ওয়ার। পূর্ণ-প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে ২০০০ সালে যে টেস্ট স্ট্যাটাস তথা আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ দেয়া হয়েছিলো তার পেছনেও অন্যতম কারণ ছিল এই কোল্ড-ওয়ার। পূর্ণ সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের ভোটাধিকার আইসিসিতে ইন্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ব্লকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলো।

এখন ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের যৌথ প্রস্তাবনা এক অর্থে ক্রিকেটীয় সেই কোল্ড ওয়ারের অবসানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড গত এক দশক ধরে ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই এর সাথে নানা বৈরিতায় জড়িয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। এখন তারা সেই বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে বিসিসিআই এর সাথে জোট বেধেছে। ফলে বিশ্ব-ক্রিকেটের সাবেক প্রভু আর বর্তমান প্রভুদের সম্মিলিত রূপই হল ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের জোট।

ক্রিকেটের অন্যদেশগুলোর ভোটাধিকার এক অর্থে মূল্যহীন। কারণ ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই ভোটাধিকারের শক্তিকে অর্থহীন করে ফেলেছে। যেমন, ক্রিকেটে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মূল্যায়নে প্রযুক্তির ব্যবহারের ডিআরএস পদ্ধতি সার্বজনীন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড ছাড়া আইসিসির সকল দেশ একমত। শুধুমাত্র বিসিসিআই এর আপত্তির কারণে এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে  এই, ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড এর অমতে আইসিসিতে কোন সিদ্ধান্তই নেয়া যায় না।        

নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মূলত: এই তিন দেশের সমন্বয়ে একটা নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হবে। চার সদস্যে এই নিরাপত্তা পরিষদে এই তিন দেশের স্থায়ী সদস্য পদ থাকবে এবং চতুর্থ স্থানটি বাকি সাত টেস্ট খেলুড়ে দেশের পক্ষ থেকে একজন এসে পূরণ করবে। আইসিসির সিদ্ধান্ত পাশ করতে হলে এই নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। অর্থাৎ, ক্রিকেট বিশ্বের শাসনভার এই তিন দেশের সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিতে হবে।

সুতরাং, ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়। এতদিন যা চলে এসেছে সেই অর্থনৈতিক স্বৈরাচারকেই এবার প্রাতিষ্ঠানিক-রূপ দেয়া হচ্ছে।

প্রমোশন-রেলিগেশনের ব্যবস্থাসহ দুই-স্তর বিশিষ্ট টেস্ট ক্রিকেটঃ

ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের প্রস্তাবিত নিয়মে টেস্ট ক্রিকেট খেলবে আটটি দেশ। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েকে টেস্ট ক্রিকেট  থেকে বিদায় জানিয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে খেলবে সহযোগী দেশগুলোর সাথে।  তাদের মধ্যে সেরা দলটি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর টেস্ট ক্রিকেটের অষ্টম দেশের সাথে প্লে-অফ খেলার সুযোগ পাবে এবং সেই অষ্টম স্থানের দলকে হারাতে পারলে নতুন একটি দল টেস্ট খেলার সুযোগ পাবে। তবে ইন্ডিয়াইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এই তিন দল কখনো রেলিগেটেড হবে না।  তার মানে এই, বাংলাদেশের টেস্ট ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ। এখন থেকে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড বা আফগানিস্তানের মতো দলের সাথে চার বা পাঁচ দিনের ম্যাচ খেলবে। এভাবে পাঁচ বছর খেলার পর তাদের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশ সুযোগ পাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলার ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার। পাঁচ বছর শক্তিশালী দলের সাথে খেলার সুযোগ না পেয়ে পাঁচ বছর পর যখন বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের মুখোমুখি হবে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তার মানে দাঁড়ায়, আমাদের টেস্ট ক্রিকেট জীবনের এখানেই ইতি।

বাংলাদেশের এতো বড় সর্বনাশ করে ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের লাভ কিবাংলাদেশ টেস্ট খেলুক কি না খেলুক তাতে ইন্ডিয়ার কিছু আসে যায় না। বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে দিলে বাংলাদেশের সাথে খেলার প্রশ্ন আসে। বাংলাদেশের সাথে খেলার বাধ্যবাধকতার একটা বিধান হল আইসিসির ১০-বছর মেয়াদী ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম (এফটিপি)। এখন তো নতুন প্রস্তাবনায় এফটিপি উঠিয়ে দেয়ার কথা হয়েছে। তাহলে  অন্যদের মতো বাংলাদেশকেও দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে টেস্ট খেলার সুযোগ করে দিতে ইন্ডিয়ার সমস্যা কোথায়?

ইন্ডিয়ার কোন সমস্যা নেই। সমস্যা ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায়। আইসিসির রাজনীতিতে বাংলাদেশ তাই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার কাছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাক ক্রিকেট-রাজনীতির সমীকরণের কারণেই তারা শুরুতেই সেটা চায় নি। এরপর যতবারই বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়ার প্রসঙ্গ উঠেছে সেটা এসেছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ব্লক থেকেই। এছাড়া রবার্ট মুগাবে সরকারের সাথে রেষারেষির ফল হিসাবে জিম্বাবুয়েকে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া প্রকাশ্য শত্রু হিসাবে ঘোষণা করেছে। জিম্বাবুয়ের সাথে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক অবরোধ তো আছেই, এই দুই দেশ জিম্বাবুয়ের সাথে ক্রিকেটীয় সংযোগও ছিন্ন করেছে।  ইংল্যান্ড এমনকি জিম্বাবুয়েকে আইসিসি থেকে বহিষ্কারের দাবীও তুলেছে। ফলে বাংলাদেশের সাথে জুড়ে দিয়ে জিম্বাবুয়েকে শায়েস্তা করার এই এক বড় সুযোগ।

ইদানীং আবার আয়ারল্যান্ডের ও স্কটল্যান্ডের টেস্ট ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা উঠছে। সেসব দেশের ক্রিকেটের মান, জনপ্রিয়তা, খেলোয়াড়ের সংখ্যা  ও ক্রিকেটীয় অবকাঠামো অত ভালো পর্যায়ে নেই বলে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের মতো আরো কিছু টেস্ট শিশু তৈরি করা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়েকে তাই আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ড-হল্যান্ডের সাথে নামিয়ে দিতে পারলে বরং  ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ব্লকের এসব দেশের জন্য কিছু সম্ভাবনা তৈরি করা যায়।

এই পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো ইন্ডিয়া। কিন্তু ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার এই যৌথ প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে মূলত: এই ক্রিকেটীয় কোল্ড-ওয়ার এর পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। ফলে বিশ্ব রাজনীতির কোল্ড-ওয়ার এর পরিসমাপ্তিতে যেমন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার রাজনৈতিক গুরুত্ব করে গিয়েছিল, ক্রিকেটীয় কোল্ড-ওয়ারের অবসানের মধ্য দিয়েও ক্রিকেট রাজনীতিতে ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। ফলে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ব্লকের সাথে সমঝোতার খাতিরে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট খেলার ভবিষ্যতকে বলি দিয়ে দিতে ইন্ডিয়ার কোন আপত্তি নেই। এই পরিকল্পনা ইন্ডিয়ার জন্য ফিউচার-প্রুফও বটে। কারণ এই যৌথ প্রস্তাবে বাংলাদেশের পূর্ণ সদস্যপদ কিংবা  টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়ার কথা বলা হয়নি, শুধু বলা হয়েছে টেস্ট খেলতে দিতে না দেয়ার কথা। ফলে ভবিষ্যতে কোন ওলট-পালট হলেও এশিয়ান ব্লকের ভোটাধিকারে কোন হেরফের হচ্ছে না।

সার্বিক মূল্যায়নঃ

ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার এই যৌথ প্রস্তাবনার  আইসিসি আয়-রোজগারের ভাগবন্টন এবং এফটিপি বাতিল করে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ট্যুর প্রোগ্রাম আয়োজনের বিষয়গুলো অর্থনৈতিক। ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে প্রস্তাবের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা চলবে না। এটা মেনে নিতেই হবে। অন্যথায় আইসিসির কোন ইভেন্টে ইন্ডিয়া অংশ নেবে না। অর্থনৈতিক বিষয়াদি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে বিসিসিআই  এর আপত্তি নেই। এই থেকে ধারণা করা যায়, টাকা-পয়সার ব্যাপারে বিসিসিআই এর দাবী মেনে নিলে অন্য বিষয়ে তারা ছাড় দিতে রাজী।

এখন এই ছাড় পাওয়ার দেন দরবারে অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সাথে সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের স্বার্থের ফারাক আছে। অন্যদেশের টেস্ট ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। তাই অন্যান্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড দেন দরবার করবে (১) আইসিসি নির্ধারিত ক্রিকেট ট্যুর প্রোগ্রামের অনুপস্থিতিতে ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলা পাবার নিশ্চয়তার প্রশ্নে, (২) আইসিসির পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দেয়ার প্রশ্নে এবং (৩) সবার জন্য সমান রেলিগেশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রশ্নে।

ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে আইসিসির আয়ের সিংহভাগ অংশ ছেড়ে দিলে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ কিছু ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও তিন দেশকে আইসিসির আয়  দখল করে দিতে না দিলেই বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। উদাহরণ দেয়া যাক, ২০০৮ সালে পাকিস্তান তাদের দেশে আগামী ৪ বছরের জন্য হোম সিরিজের টিভি সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছিলো ১৪০ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে ৯০ মিলিয়ন তারা পেয়েছিলো ইন্ডিয়ার সাথে দুটো সিরিজ খেলার পরিকল্পনার ভিত্তিতে। ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে আইসিসির আয় বণ্টনের প্রস্তাব মেনে নিলে পাকিস্তানের সাথেও ইন্ডিয়া সিরিজ খেলবে। এখন পাকিস্তানের কাছে অপশন আইসিসির আয় নিয়ে কাড়াকাড়ি কড়া কিংবা ইন্ডিয়ার সাথে সিরিজ খেলে সেখান থেকে টাকা আয় করা। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাবের অর্থনৈতিক ধারাগুলো মেনে নেয়ার পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান নেয়ার সম্ভাবনাই বেশী।  শ্রীলঙ্কার অবস্থাও একই রকম। তারাও এই প্রস্তাবের উপর আলোচনা আপাতত স্থগিত রাখা কথা বললেও প্রস্তাবের বিপক্ষে কিছু বলেনি। কারণ সম্প্রতি টেন স্পোর্টস এর সাথে তারা শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় হোম সিরিজগুলোর সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে মোটা অঙ্কের চুক্তি করেছে। সেই চুক্তির অন্যতম অংশ হল ২০১৭ সালে ইন্ডিয়ার সাথে হোম সিরিজ। এখন ইন্ডিয়ার সাথে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লে যদি সেই সিরিজ বাতিল হয়ে যায়, তবে এই সম্প্রচার চুক্তির টাকার পরিমাণ বহুলাংশেই কমে যাবে। একই অবস্থায় আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। নিউজিল্যান্ড তো ইতোমধ্যেই সমর্থন জানিয়ে বসে আছে। জিম্বাবুয়ে এই নিয়ে কথা বলবে কি, তারা আছে নিজের দেশের খেলোয়াড়দের ধর্মঘট নিয়ে ঝামেলায়। ধর্মঘটে ঘরোয়া সব খেলাও বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা আছে একাকী। সুতরাং তারাই তীব্র ভাষায় প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।

আইসিসির আয়ের বেশী অংশ ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে যদি বড় দলগুলো থেকে ম্যাচ পাওয়া যায়, সেই আশায় অন্যেরা এই প্রস্তাব মেনে নেবে বলে ধারণা করা হয়। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছে। ইন্ডিয়া হয়তো দরকষাকষির জন্য এখনো এই নিশ্চয়তা দেয়নি। কিন্তু ইন্ডিয়ার সাথে খেলার নিশ্চয়তা পেলে চরম পাকিস্তানের মতো চরম রাজনৈতিক শত্রুও ইন্ডিয়ার দাবী মেনে নিবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাকি সব দেশ আইসিসির আয়-রোজগারের উপর  ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে সিংহভাগ দখল ছেড়ে দিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পাবার শর্তে এবং নিরাপত্তা পরিষদের মতো এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন না করা ব্যাপারে হয়তো কিছু সমঝোতা করে নিতে পারবে। কারণ এই আগেই বলা হয়েছে, এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন করে আইসিসি নতুন করে দখল নেয়ার কিছু নেই। সেটা ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক দাপটে দখল হয়ে বসে আছে।

বাংলাদেশকেও হয়তো দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ওয়ানডে সিরিজের টোপ দেয়া হবে। এভাবে অন্যান্য দেশের সাথে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বাংলাদেশও সবার মতো সমঝোতায় আসতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশকে যে শুরুতেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে ঝাঁটিয়ে বিদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তার ব্যাপারে দেন দরবারের দায় বাংলাদেশের একার। এই দেন দরবার অন্য দেশের অবস্থান দেখে করবার মতো সময় হাতে নেই। তাই বাংলাদেশের টেস্ট ভবিষ্যৎ রক্ষায় প্রয়োজন ক্রিকেটীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ে ইন্ডিয়ার সাথে দেন দরবার। ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের সমঝোতায়  ক্রিকেটীয় কোল্ড ওয়ারের অবসান ঘটায় বাংলাদেশের ভোটাধিকারের মূল্য এমনিতেই কমে গেছে। বাংলাদেশের টেস্ট খেলার অধিকার রক্ষায় অন্যদেশকে পাশে পাবার সম্ভাবনাও নেই। তাই আইসিসির পরিমণ্ডলে দেন-দরবার সীমিত না রেখে ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক সমঝোতাকে পুঁজি করেই এগুতে হবে।

সর্বোপরি বিবেচনা করে দেখলে, এই প্রস্তাবনা ক্রিকেটের জন্য শুভ কিছু নয়। বিশ্ব ক্রিকেট পরিচালনায় অগণতান্ত্রিক নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি সহযোগী দেশগুলোর উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা এই প্রস্তাবে করা হয়েছে। ক্রিকেটের স্পোর্টিং মূল্যের চাইতে বড় করে দেখা হচ্ছে খেলা থেকে আয় রোজগারের বিষয়টিকে।   ক্রিকেট বিশ্ব এতো দিন ইন্ডিয়ার ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই এর দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে এসেছে বলে আজ আইসিসির আয় আমার-ক্ষমতা আমার জাতীয় নগ্ন প্রস্তাব প্রকাশ্যে তুলে ধরা যাচ্ছে।  স্বল্পমেয়াদী লাভা-লাভের বিবেচনায় ক্রিকেট বোর্ডগুলো যদি এই ব্যবস্থা মেনে নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে  আরো অনেক বড় অধিকার এভাবেই ভুলন্ঠিত হতে দিতে হবে। তাই মন বারবার করে চায়, নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ ম্যান্ডলার মতো সংগ্রামী চেতনায় সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক।