১৮ নভে, ২০১৩

তাগড়ার মল্লযুদ্ধ

গতকাল ছিল ১৭ই নভেম্বর।  ১৯৭১ এর ১৭ই নভেম্বর বরিশালের কোদালধোয়া এলাকায় শহীদ হন নাম না জানা এক সাহসী যোদ্ধা। নাম না জানা আরও অনেক শহীদের মাঝে সে একটু ব্যতিক্রম। শুধু মৃত্যুতেই তার নাম হারিয়ে যায়নি, জীবিত থাকতেই সে হারিয়ে ফেলেছিল বাবা-মার দেয়া নাম। সবাই তাকে ডাকতো তাগড়া নামে। বাবা-মার দেয়া নাম জানা ছিল না। বরিশাল অঞ্চলে চর-দখলের লড়াকু লাঠিয়াল সে। তার বিশাল বুক জুড়ে ছিল তিন তিনটি বল্লমের আঘাতের দাগ। মাথায় ঘন কালো চুল আর দীর্ঘদেহের এই অমিত শক্তিমান লাঠিয়াল চর অঞ্চলে এতোই প্রতাপসম্পন্ন ছিল যে তার শরীরের সাথে মানানসই এই তাগড়া নামেই সকলে তাকে জানতো। 

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। বরিশাল অঞ্চল পাক-হানাদার বাহিনীর দখলে। বরিশালের স্বরূপকাঠিতে শর্ষিনার পীরের বাড়ি তখন পাক বাহিনীর আস্তানা ও স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। সেখানে আস্তানা গেড়ে পীর সাহেবের আতিথেয়তা ও সহযোগিতায় স্বরূপকাঠি ও ইন্দোরহাট এলাকায় পাক বাহিনী তখন নারকীয় তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। পীর সাহেবের আস্তানায় ঘাটি গেড়ে বসা থেকে এই হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দেয়ার জন্য সুন্দরবন থেকে একযোগে এগিয়ে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের  ১৫/১৬টি দল। লে: সাঈদের নেতৃত্বে ৫১ জনের  এমনই একটি দলের সদস্য তাগড়া। মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে ততদিনে লাঠিয়াল থেকে তাগড়া পরিণত হয়েছে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধায়। যুদ্ধে সাহসিকতা আর রাজাকারদের ধরে  নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলো সে। 

১৭ই নভেম্বর, বুধবার। নাজিরপুর-পিরোজপুর-পাটগাতি-কোটালিপাড়া পেরিয়ে  তাগড়াদের দল তখন এসে পৌঁছেছে কোদালধোয়া এলাকায়। ঠিক সে সময় আচমকা অপরদিক থেকে অগ্রসরমান শতাধিক পাক সৈন্যের এক দলের মুখোমুখি হয়ে গেলো লে: সাঈদের দল। মাত্র দেড়শ গজ ব্যবধানে অবস্থান নিয়ে অনেক সময় ধরে গুলি-পালটাগুলি চলল দুই পক্ষের মধ্যে। একে অন্যের শক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দুই পক্ষই সতর্ক অবস্থানে থেকে চলতে চাইছে। দিনভর চলতে থাকা লড়াইয়ের পর হঠাৎ করেই থেমে গেল সব গোলাগুলি। সুনসান নীরবতা। স্নায়ুতে প্রবল চাপ। এর মাঝেই হঠাৎ করে বিশাল-দেহী এক পাকসেনা অস্ত্র মাথার উপর ধরে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে গিয়েই  পরনের সেনা পোশাক একটানে ছিঁড়ে ফেলে দিলো।    ক্লান্তিকর এই যুদ্ধে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এই হানাদার সৈনিক। চিৎকার করে বলতে লাগলো, সতী মায়ের দুধ খেয়ে বড় হওয়া কেউ যদি থাকে তো এগিয়ে আসো খালি হাতে। বলেই হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর পায়ে পায়ে সে এগিয়ে আসতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে। পাগলাটে এই পাকসেনার কান্ড দেখে হতবাক মুক্তিযোদ্ধারা কেউ গুলি ছুঁড়ল না।

খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া তাগড়া তখন অস্ত্র হাতে তার পজিশনে শুয়ে আছে। হানাদার সৈন্যের এই দাম্ভিক চ্যালেঞ্জ শুনে সে আর শুয়ে থাকতে পারলো না।  লে: সাঈদের দিকে এক নজর তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলোহালায় মনে করছে কি? বাঙ্গালী গো মধ্যে কি কেউ নাই তার লগে লড়তে পারে? মিয়া ভাই, তাগড়ারে আর ধইরা রাখতে পারলেন না। হালার পো হালায় বেজায়গায় হাত দিছে। বলেই লুঙ্গি গোছ মেরে দাঁড়িয়ে গেল তাগড়া।  সোজা গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এগিয়ে আসা পাক সৈন্যের সামনে। উদোম দেহে দুই সৈনিক খালি হাতে তাকিয়ে আছে একে অন্যের দিকে। দুই পক্ষের বাকি সবাই চুপচাপ দেখতে লাগলো এই দুই পাগলাটে সৈনিকের কান্ড। কেউই কোন গুলি ছুঁড়ল না। তাগড়া এগিয়ে গিয়ে হিংস্র বাঘের মতো সজোরে এক থাবা বসিয়ে দিলো পাক সৈন্যের বুকের বাম দিকে। প্রচন্ড থাবার ধাক্কায় টলতে টলতে পাক সৈন্যটি কোন রকমে আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই প্রতিপক্ষের সৈন্যরা চালিয়ে দিলো গুলি তাগড়াকে লক্ষ্য করে।  গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছিটকে পড়ে গেল তাগড়া। আর পাক সৈন্যটি ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরে তাদের নিজের অবস্থানে।

মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের মাথায় তখন রক্ত উঠে গেছে। প্রবল বেগে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা এগিয়ে গেল শত্রুর  অবস্থানের দিকে। প্রায় বিনা প্রতিরোধেই দখল হয়ে গেল শত্রুর অবস্থান বুহ্য। তারা গিয়ে দেখল প্রায় শতাধিক সৈন্যের মধ্যে কেবল জনা পাঁচেক সৈন্য বাদের বাকি সব পাক সেনা মরে পড়ে আছে। এই মৃতদেহের মাঝেই একদিকে মরে পড়ে আছে সেই পাগলাটে হানাদার সৈন্যটিও। বন্দি সৈন্যরা জানালো, তাগড়ার উপর গুলি চালানোর পর সেই সৈন্যটি  নিজের অবস্থানে ফিরে এসে মেশিনগান নিয়ে উন্মাদের মতো গুলি করে হত্যা করেছে পুরো পাক সেনাদের দলটিকে। খালি হাতে লড়তে এগিয়ে আসা সতী মায়ের দুধ পান করে বড় হওয়া   প্রতিপক্ষের এক যোদ্ধাকে কাপুরুষের মতো এভাবে গুলি করে মেরে ফেলাকে সে মেনে নিতে পারেনি। তাই  অস্ত্র তুলে নিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে নিজের বাহিনীকেই।

নিজের দেশের মাটিতে এসে এক হানাদার পাক সেনার এই দম্ভ মেনে নিতে পারেনি তাগড়া। দেশের সম্মানের জন্য সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। তাই নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও দেশের ও মায়ের সম্মান রাখতে খালি হাতে মল্লযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো তাগড়া। কিন্তু আমরা তাগড়াকে  কোন সম্মান দেখাতে পারিনি। ১৭ই নভেম্বরে তার মৃত্যু দিবস তাই কোথাও পালিত হয় না। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়েও আমদের অনেকেই তাগড়ার এই গল্পের কথা জানতেও পারিনি। আর সেই পাগলাটে পাকসেনার কথা তো বলাই বাহুল্য। নীতি-নৈতিকতার দায়ে যেসব সাহসী মানুষ নিজ দলের বিপক্ষেও অবস্থান নিতে পারে, তারা সব যুগেই অবহেলিত, উটকো ঝামেলার বস্তু। তাই পাকবাহিনীর কাছে হয়তো সে চিহ্নিত হয়েছে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসাবে। একাত্তরে লাখো হত্যা আর নির্মমতার শিকার এই আমাদের কাছে সে স্বাভাবিকভাবেই কেবলই নির্মম হানাদারদের দলের একজন।

বরিশাল অঞ্চলে শর্ষিনার পীর আনুকূল্যে আস্তানা গাড়া হানাদার বাহিনীর হাত থেকে  দেশের মাটিকে মুক্ত করতে কোদালধোয়া এলাকায় সেদিন খালি হাতে উদোম শরীরে মল্লযুদ্ধে এক পাকসেনার মুখোমুখি হয়েছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিনের সেই মল্লযুদ্ধের দুই পাগলাটে যোদ্ধাই আসলে হেরে গেছেন। সেই পাকসেনা নিশ্চয়ই নিজ দেশে  হয়েছে ঘৃণিত। আর দেশের সম্মানে জীবন দেয়া তাগড়াকে আমরাও মনে রাখিনি।  এরা দুজনেই হেরে গেলেও জয়ী হয়েছেন একজন...শর্ষিনার পীর সাহেব। ১৯৮০ সালে শর্ষিনার পীর সাহেবকে  স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার !!
  

বিঃদ্রঃ তাগড়ার এই মল্লযুদ্ধের তথ্য মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা শিরোনামের বই থেকে নেয়া।

1 টি মন্তব্য:

Md.Nehal Uddin বলেছেন...

Ojana tottho, ojana Etihash.
"Tagra" ei naamtar sharthokota ta asholei porichoi dia geche shei ojana prio naam "Khepatee Tagra".
Emon onek khepate joddhader attoteg er jonnoi to aaj amra BANGLA te kotha boli-likhi.
Its a really very tragic history of 1971 !!!!
Salute for you "Khepate Tagra" :)