৫ আগ, ২০১০

অলক্ষুণে কবিতা

জীবনে কোন না কোন সময় সব মানুষই নাকি একবার হলেও কবি হয়। আমিও হয়েছিলাম। কাঁচাহাতে লেখা কৈশোরের দুর্বল কবিতা, কিন্তু তাতেই আমার জীবন ঝালাপালা। নব্বুই-একানব্বইয়ের দিককার ঘটনা। আমি সবে মাত্র মাধ্যমিকের পাট চুকিয়েছি। মফস্বল শহরে বন্ধুত্বের বৃত্তে চলছে জীবন। বন্ধুদের কেউ নব্য বিপ্লবী --- বামপন্থায় দীক্ষা নিচ্ছে। কেউ বা নব্য কবি --- কাব্য সাধনায় ব্যস্ত। এদের মাঝে বেমানান আমি ক্রীড়ামোদী তরুণ --- খেলাধুলো করে হেসে খেলে জীবন কাটানোর গোপন স্বপ্নে বিভোর। নব্য বিপ্লবী আর নব্য কবি বন্ধুরা তাদের বন্ধুচক্রে এই সৃস্টিহীন ক্রীড়া-প্রেমীর উপদ্রব মেনে নিতে নারাজ। দুই পক্ষের প্রভাবে আমি আধা-বিপ্লবী আর আধা-কবি হয়ে কোন কুক্ষণে যেন লিখে ফেললাম জীবনের প্রথম কবিতা। আর যায় কোথায়? কাঁচা হাতের লিখা এই কবিতাই আলী আবু আম্মুরীর অলক্ষুণে জুতো হয়ে দেখা দিল আমার জীবনে।

সেই সময়ই কোথা থেকে যেন একবার সঞ্জীব চৌধুরী নামে বিপ্লব আর শিল্পের যৌথ-সত্ত্বার এক মানুষ (তিনি তখনো দলছুটের সঞ্জীব হয়ে উঠেননি) এসে হাজির হলেন আমাদের বিপ্লবী আর কবি বন্ধুদের আড্ডায়। বন্ধুরা তাদের কৃতিত্বের গল্প শোনালো: আমার মতো সৃস্টিহীন মানুষও কিভাবে তাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সম্প্রতি এক কবিতা ঝেড়ে ফেলেছে। কথায় কথায় সেই কবিতা পড়লো সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে, যিনি তা পড়লেন এবং ফেরার সময় পকেটে ভরে নিয়ে চলে গেলেন ঢাকায়। সপ্তাহ খানিক পর জানা গেল ঢাকা থেকে ছাত্র ইউনিয়নের একুশের প্রকাশনা জয়ধ্বনিতে ছাপা হয়েছে আমার সেই অলক্ষুণে কবিতা। বন্ধুরা বলল, “ওরে, ছাড় তোর খেলাধুলা, তুই তো এখন কবি”।

বন্ধুরা হৈ হৈ করে সেই জয়ধ্বনির কপি নিয়ে গেল কলেজ সাময়িকীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকের কাছে। তিনি সেটা আবার ছাপিয়ে দিলেন কলেজ বার্ষিকীতে। সেই কলেজ বার্ষিকী গিয়ে পড়লো কলেজের এক সুদর্শনা মেধাবী তরুণীর হাতে, যে কিনা আবার সেই কবিতা নিয়ে উঠে গেল কলেজের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের আবৃত্তি মঞ্চে। সেই কবিতা এরপর আর কোথাও গিয়ে পড়লো না, বরং আমিই আহ্লাদে গদগদ হয়ে গিয়ে পড়লাম সেই সুদর্শনা মেধাবী তরুণীর প্রেমে। প্রেমে তো পড়লাম, কিন্তু ভীরু মনে প্রেম নিবেদনের সাহস আর হয়ে উঠে না। একবার ভাবলাম কাব্যের ভাষায় বলি। কিন্তু কাব্যের কোলে আশ্রয় মিলল না - বেরুলো না একটি শব্দও। বেরুবে কিভাবে-বন্ধুদের সমতুল্য হবার তাড়া থেকেই না কোন কুক্ষণে লিখেছিলাম সেই একটা মাত্র কবিতা। অতঃপর ভাবলাম এবার না হয় সেই সুদর্শনা মেধাবী তরুণীর সমতুল্য হবার চেষ্টা করে দেখি যদি প্রেম নিবেদনের কোন কুল-কিনারা করা যায়। ব্যস, লাটে উঠলো আমার খেলাধুলা, বিপ্লব, কাব্য সবকিছুই। মন ডুবালাম পড়াশোনায়। তবে প্রেমের মরা যেমন জলে ডুবে না, আমিও ডুবলাম না। বরং ভেসে উঠলাম উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায়। কি প্রেমেই না পড়েছিলাম! আগডুম-বাগডুম করে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই মেয়ের সামনে। মনে বড় আশা, এককালীন সাময়িকীতে ছাপা হওয়া আমার কাব্য প্রতিভা আর আজকের পত্রিকায় ছাপা হওয়া আমার কৃতিত্বের ছবি মিলিয়ে আমাতে মুগ্ধ হয়ে সেই মেয়ে নিশ্চয়ই আজ নিজ থেকেই ভালোবাসা-ভালোলাগার গল্প-কথা কিছু বলবে। মেয়ে নিজ থেকেই বলল। ভালোবাসার গল্পই বলল। তবে সে গল্পের নায়ক অন্য কেউ। ভালোবাসার এই গল্পে আমার অবস্থা যেন সেই মক্কাবাসীর মতো যে মক্কায় থেকেও হজ্বের আসর ধরতে পারেনি।

হতাশ হৃদয়। খেলাধুলোয় আর মন বসলো না। ফিরে গেলাম বিপ্লবী বন্ধু আর কবি বন্ধুদের মাঝে কাব্য আর বিপ্লবের সন্ধানে। বন্ধুরা বলল, “ওরে, ছাড় তোর কাব্য আর বিপ্লব, তুই তো এখন মেধাবী”। অবশেষে সেই সিল নিয়েই পড়াশোনার নিরস জগতে মুসাফিরের মতো ঘুরে বেরাতে থাকলাম। আজও সেই পথে পথে ঘোরা সেই হয়নি। বরং এই দুপুর বেলায় কঠিন এক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পড়ার টেবিলে বসে মনে হল- আমার খেলাধুলার সেই আমোদিত জীবন কেড়ে নিলো এক অলক্ষুণে কবিতা। জীবনে ওই একবারই লিখেছিলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ। এই সেই অলক্ষুণে কবিতা। শালার এই কবিতার মায়েরে বাপ!

দাবী

বায়ান্নতে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, ভাষা চাই।
বিধাতা ভাষা দিলেন।

একাত্তরে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, স্বাধীনতা চাই।
বিধাতা স্বাধীনতা দিলেন।

নব্বুইতে
দু’টো দাবী জানালাম বিধাতার কাছে।
প্রথমটি প্রত্যাখ্যান করে বিধাতা বলেন, অপরটি বলো।
বললাম, গণতন্ত্র চাই।
বিধাতা গণতন্ত্র দিলেন।

যদিও বিধাতার মেনে নেয়া দাবীগুলোর
ঘটাতে পারিনি বিকাশ
তবুও এক গভীর রাতে
শত যুগের, শত শতাব্দীর প্রত্যাখ্যাত
সেই একটি মাত্র দাবী নিয়ে দাঁড়ালাম বিধাতার কাছে
বললাম, অন্ন চাই, অন্ন চাই, অন্ন চাই।
বিধাতা বলেন,
অন্ন নয়; অন্য কথা বলো।

কোন মন্তব্য নেই: