পঞ্চগড় থেকে ঘুরে এলাম।
পঞ্চগড়ের ভেতরগড়-অমরখানা-জগদলহাট-বেরুবাড়ি-সোনারবান-নালাগঞ্জ-সর্দারপাড়া-মহারাজদীঘি-তলমা
নদীর পাড়...এসব এলাকায় একাত্তরের এক গেরিলা দলের সাথে কেটেছে আমার গত কয়েকটি রাত।
মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে এত কাছ থেকে দেখার দেখার, মুক্তিযুদ্ধের গণ-চরিত্রকে এভাবে অনুভব করার সুযোগ এর আগে আমি আর কখনো
পাইনি। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহবুব আলমের “গেরিলা থেকে
সম্মুখ যুদ্ধে” নামের প্রায় ১২০০ পাতার বইটি আমাকে এই অনন্য অভিজ্ঞতার
মধ্যে নিয়ে গেছে। আমার সীমিত পড়াশোনায় এটি মুক্তিযুদ্ধের উপর এযাবৎ কালের
শ্রেষ্ঠতম বই। নির্দ্বিধায় আবারো বলছি, মুক্তিযুদ্ধের উপর
আমার পড়া শ্রেষ্ঠতম বই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুরসহ শ্রেণীগোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ পাক হানাদার
বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের
মুক্তিযুদ্ধ যে গণযুদ্ধের রূপ নিয়েছিলো, তার বর্ণনা এই
রকম সামান্য কিছু বাক্যেই শেষ। মুক্তিযুদ্ধের গল্পে-ইতিহাসে আর বাকি সবই সামরিক
বাহিনীর তৎপরতা আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কর্মকাণ্ডের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ।
সাহিত্য-প্রকাশ থেকে প্রকাশিত মাহবুব আলমের “গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে” বইটি
এই সকল সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগহণের ছবিটি দারুণ ভাবে
তুলে এনেছে। সেই ১৯৯১ সালে প্রকাশিত বইটি, এই রত্নটি
কিভাবে এতকাল আমার চোখের আড়ালে রয়ে গেল...সেটাই এক বিস্ময়।
১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
রসায়নের ছাত্র রংপুরের ছেলে মাহবুব আলম। যুদ্ধের সময় এক গেরিলা দলের কমান্ডার
হিসাবে তাকে সপ্তাহে দুইবার তার দলে তৎপরতার রিপোর্ট করতে হতো। সেই রিপোর্টিংয়ের
জন্য তার নোটবুকে তিনি কয়েক লাইনে টুকে রাখতেন প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা।
এরকম তিনটি ফিল্ড বুকের উপর ভিত্তি করে স্মৃতি থেকে তিনি তুলে এনেছেন
মুক্তিযুদ্ধের এর অবিশ্বাস্য চিত্র...যার পুরোটা জুড়েই আছে একবারে সাধারণ মানুষের
শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের সম্মিলিত যুদ্ধের কথা, যুদ্ধে গ্রামের গণ-মানুষের অংশগ্রহণের পুঙ্খানুপুঙ্খ জীবন-ঘনিষ্ঠ
বর্ণনা।
আমাদের চেনাজানা বন্ধু মহলের
সবার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ...এখনো যারা পড়ে দেখেননি...অবশ্যই পড়ে নিবেন। এখুনি।
দেশে বইয়ের দোকানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। বিদেশে যাদের সহজে বাংলা বই হাতে পাবার
সুযোগ নেই, ইন্টারনেটে খুঁজলে
তারাও পিডিএফ আকারে পেয়ে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধকে এক নতুন ভাবে অনুভবের সুযোগ এনে
দিবে এই বইটি। পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে দেখবেন
পিন্টু-মতিয়ার-মধুসুদন-জহিরুল-অহিদার-গোলাম গউস-হাসান-আক্কাস-একরামুল-মজিব-দুলু-মন্টু-বাবলু-মুকতু
মিয়া-জোনাব আলী-হাসান মাঝি এসব গণমানুষের চরিত্রগুলো অজান্তেই কখন যেন কত আপন হয়ে
যায়। কর্নেল-ক্যাপ্টেন-মেজরদের মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি আপনি এসব গন-যোদ্ধাদের
মধ্যদিয়ে দেখতে পাবেন এক জনযুদ্ধের রূপ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন